প্রতিবছর বর্ষামৌসুমে অতি বৃষ্টি ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে ফেনীর ৩ উপজেলা ফুলগাজী পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মুহুরী কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বাঁধ ভেঙ্গে মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, মৎস্যঘের ও বীজতলা এবং নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। নদীর দুই কুলে বসবাসরত মানুষজনকে বন্যায় তাদের ভিটেবাড়ি হারিয়ে অসহায় জীবন যাপন করতে হয়। বর্ষা এলে নদীর পাড়ের মানুষের চোখে ঘুম হারাম হয়ে যায়। কখন জানি নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলে বাঁধ ভেঙ্গে তাদের স্বপ্নের ঘরবাড়ি হারাতে হয়। এসব সমস্যা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। ২০০৪ সালে পরশুরামে মুহুরী নদীর দুই পাশের সম্প্রসারনে ১শ মিটার দুরত্বে বাঁধ নির্মাণের জন্য ১৬৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে এনে নদী সংলগ্ন পুরোনো বাঁধের উপর নতুন বাঁধ নির্মাণের কাজ ২০০৬ সালে শুরু হয়ে ২০১২ সালে শেষ করা হয়। বাঁধ নির্মাণের পর সঠিকভাবে তদারকির ব্যবস্থা না থাকায় নদী থেকে প্রতিবছর কিছু অসাধু সিন্ডিকেট অবৈধভাবে বালু ও মাটি উত্তোলন করে থাকে। যার কারনে বাঁধে ফাটল সৃষ্টি হয় ও দেবে যায়। তখন পানির তীব্র ¯্রােতে বাঁধ ভেঙ্গে যায়।
চলতি মাসের ১২ জুলাই রাতে কয়েকদিনের টানা বর্ষনের কারনে ও ভারতের পাহাড়ি ঢলের পানির চাপে ফুলগাজী পরশুরাম উপজেলার মুহুরী কহুয়া নদীর বাঁধের ৯টি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দেয়। এর ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা ফসলি জমি আমনের বীজতলা পুকুর ও গ্রামীণ সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। দুই উপজেলার ২০ গ্রামের প্রায় ১২শ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায় ওইদিন সন্ধ্যায় নদীর পানি বিপদসীমার ১শ ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। পরদিন সকালে ফেনী জেলা প্রশাসক মো: ওয়াহিদুজ্জামান বন্যা কবলিত এলাকা ও ভাঙ্গনের স্থান পরিদর্শন করেন এবং পানিবন্দি মানুষের খোঁজ খবর নেন ও তাদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন।
এদিকে গত ১৫ জুলাই ফেনীতে আসেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার। তিনি ওই দিন সকালে সম্প্রতি ফুলগাজী-পরশুরামে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ও নদীর ভাঙা বাঁধ পরিদর্শন করেন এবং বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। এরপর ওইদিন দুপুর ২ টার দিকে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে ফেনীতে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মী ও জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সাথে মতবিনিময় করেন। সভায় সিনিয়র সচিব বলেন, বাঁধ সংশ্লিষ্ট বিভাগককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাঁধের ভাঙ্গনস্থানগুলি চিহিৃত করে সংস্কার কাজ দ্রুত শুরু করার জন্য। তিনি বলেন, মুহুরী কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর উপর কিছু কিছু অংশে এলজিইডি’র ব্রীজ রয়েছে,এই ব্রীজগুলো খুব নিচু। ব্রীজের কারনে নদীর পানির গতিপথ আটকে গিয়ে বাঁধে চাপ সৃষ্টি হয়,তখন বাঁধ ভেঙ্গে যায়। নিচু ব্রীজগুলো ভেঙ্গে উঁচু ব্রীজ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
তিনি আরো বলেন, ইতিমধ্যে ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে যা আগামী দুই মাসের মধ্যে একনেকে উঠবে। বাংলাদেশের ফেনী অংশে নদীর দুই পাশে প্রায় ৯২ কি:মি: বাঁধের কাজ হবে। নদী খনন করে নদীকে চওড়া করা হবে যাতে পানির ধারন ক্ষমতা বাড়ে। যেসব দূর্বল জায়গা রয়েছে সেখানে লুপকাটিং করে সোজা করার চেষ্টা করা হবে যাতে পানি সহজে চলে যেতে পারে।
এ বছরের শেষে প্রস্তাবিত প্রকল্পের কাজ শুরু হবে এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
সরেজমিনে গেলে,স্থানীয় জনসাধারন অভিযোগ করে বলেন, প্রতিবছর নদীতে ভাঙ্গন রোধে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে হলেও বাঁধের স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। পুনরায় প্রতি বছর বন্যায় নদীর বাঁধে নতুন করে ভাঙ্গন দেখা দেয়। তারা বলেন,নদীর গভীরতা কম এবং সেই সাথে নদী ঘেঁষে বাঁধ নির্মাণ করার কারনে পানির প্রবল ¯্রােতে বাঁধ টিকে না। তাই ভবিষ্যতে নদীর দুরত্বে বাঁধ দিয়ে পানির ধারন ক্ষমতা বাড়ানো না গেলে নতুন প্রকল্পের টাকাও জলে যাবে। আমরা ত্রাণ চাই না, নদীর বাঁধের স্থায়ী সমাধান চাই।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড (ফুলগাজী-পরশুরাম)’র দায়িত্ব থাকা সেকশান অফিসার মো: আরিফ জানান, গত সপ্তাহের বন্যায় নদীর ভাঙা বাঁধ সংস্কারে জরুরী নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ শুরু করা হয়েছে। মুহুরী কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর ১৪টি স্পটের ভাঙ্গন সংস্কার ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন