বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পুলিশ ব্যস্ত জঙ্গি দমন ও মন্ত্রী-এমপিদের নিরাপত্তায়

প্রকাশের সময় : ২ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উমর ফারুক আলহাদী : পুলিশ ব্যস্ত জঙ্গি দমন ও মন্ত্রী-এমপিদের নিরাপত্তায়। কোন ধরনের বিরতি নেই। দিন-রাত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যৌথ অভিযান, কূটনৈতিকপাড়া, বিপণী বিতান, সংসদ ভবন ও মন্ত্রীপাড়াসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে অন্যান্য অপরাধ দমনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সময় দিতে পারচ্ছেন না। জঙ্গিবিরোধী কর্মকা-ে ব্যস্ত থাকার কারণে হাজার হাজার মামলার তদন্ত কার্যক্রমও থমকে আছে। পুলিশকে জঙ্গি দমনে ব্যস্ত থাকার সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা। বাড়ছে মাদক ব্যবসা, চোরাচালানী, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা। এসব অপরাধ দমনে মনোযোগী হওয়ার তাদের সময় নেই।
পুলিশের বিভিন্ন স্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক মাস ধরে পুলিশের ডিউটির সময় দ্বিগুণ করা হয়েছে। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন পুলিশকে বেশী সময় জঙ্গি দমনে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। ফলে দেশে লক্ষাধিক মামলার তদন্ত কার্যক্রম এবং হাজার হাজার গ্রেফতারী পরোয়ানা থানায় পড়ে আছে। এ কারণে বিভিন্ন হত্যা মামলার আসামীসহ অপরাধীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সাধারণ অপরাধ দমনে সময় দিতে পারছেন না আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে জঙ্গি দমনে জরুরী ভিত্তিতে আরো ২০ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। পুলিশের জনবল বাড়ানো এখন সময়ের দাবী বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, পরিস্থিতি পুরোপুরি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান জোরদার করায় অন্যান্য কাজে কিছুটা সমস্যা হলেও এখন এ সমস্য কাটিয়ে ওঠেছেন তারা। তিনি বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশেই জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি অন্যান্য অপরাধ দমনেও র‌্যাব-পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সীমান্ত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে মাদক, অস্ত্র ও চোরাচালান এখন কমেছে। মাদক ব্যবসায়ী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী এবং সন্ত্রাসীরা এখন পালিয়েছে।
অন্যদিকে রাজধানীর গুলশানে জঙ্গি হামলার পর ওই এলাকার হোটেল রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে ওঠেছে। ওই এলাকায় যানবাহন ও লোকজন চলাচলেও কমে গেছে। রাজধানীর অভিজাত ও ব্যস্ততম ওই এলাকায় নেমে এসেছে নীরবতা, অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের কর্মচাঞ্চল্যতা। অতিরিক্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী ও পুলিশের তল্লাশির কারণে পারত পক্ষে গুলশান এলাকায় কেউ পা বাড়ায় না। সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে এসব জানা গেছে।
বিভিন্ন সূত্রমতে, রাজধানীতে গত এক মাসে ১৮টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসময়ের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৮৭টি চুরি ও ৭৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গত এক মাসে ১৬টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এসময়ের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধে ৭৬টি মামলা হয়েছে। সাধারণ ডায়েরী হয়েছে ৯৬টি। কিন্তু এসব মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরীর তদন্ত ও আসামী গ্রেফতারে পুলিশ সময় দিতে পারছে না।
পুলিশ সদর দফতর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সারাদেশে পুলিশের সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে কমবেশি ৩০ হাজারের মতো কর্মরত থাকেন রাজধানী ঢাকাতে। মানুষকে অধিক সেবা দিতে শুধু রাজধানীতেই এক লাখ পুলিশ দরকার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সেই পরিমাণ জনবল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নেই। জনবলের অভাবে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যকে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশে প্রতি ১ হাজার ৩০ জন মানুষের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন একজন পুলিশ সদস্য। যেখানে পাশের দেশ ভারতে রয়েছে প্রতি ৭৩০ জনের জন্য একজন এবং জাপানে ২৫০ জনের নিরাপত্তায় একজন করে পুলিশ। এ পরিস্থিতিতে পুলিশের জনবল ঘাটতির বিষয়টি একাধিকবার সংস্থাটির সদর দফতর থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে অবহিত করা হয়েছে।
রাজধানীর উত্তরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, তুরাগ, বিমানবন্দর থানা এলাকা, খিলক্ষেত, বাড্ডা, রামপুরা, মগবাজার, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, খিলগাঁও, সবুজবাগ, তেজগাঁও, পাইকপাড়া, শ্যামলী, বেড়িবাঁধ, আনন্দবাজার ও গোপীবাগ এলাকার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নানা কায়দায় মাদকের কেনা-বেচা চলছে। মাদকবিরোধী অভিযানের ভয় এখন কম। তাই কোন ধরনের রাখঢাক নয় মাদক ব্যবসায়ীরা এখন প্রকাশ্যেই অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের রমরমা বাণিজ্য। রাজধানীতে মাদক বিক্রেতাদের হিসাব অনুযায়ী চিহ্নিত সাড়ে ৭শ’ স্পটে চলছে মাদকের কেনা-বেচা। আনন্দবাজার এলাকায় গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে ইয়াবার খোঁজে আসেন তিন যুবক। পেট্রোল পাম্পের সামনে থেকে ফোন দিলে পাঁচ মিনিটের ভিতর হাজির হয়ে যায় ১৩/১৪ বছরের রুবেল। পাঁচটা ইয়াবা নিয়ে মোটরসাইকেলে করে তারা চলে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। পুলিশ এসব এলাকায় নিয়মিত অভিযান চালানোর কথা বললেও কোন অগ্রগতি নেই। তবে মাঝে মধ্যে বেশকিছু আটকের ঘটনা ঘটে।
রাজধানীর উত্তরা পশিচম থানা এলাকা ১২, ১৩, ১৪, ১০ নং সেক্টরের ২৩টি স্পটে চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের শেষ মাথায় টং দোকানের পাশে খালি জায়গায় ছোট ছোট কয়েকটি ঘর তৈরী করে সেখানে মাদক কেনা-বেচার হাট গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া ১২ নং সেক্টরে রাজউক কবরস্থানের পাশের বস্তিতে মাদকে হাট বসেছে। ফেনসিডিল, বাংলা মদ, গাঁজা এবং ইয়াবা অবাধে বিক্রি হচ্ছে। উত্তরা ৯ নং সেক্টরের পানি পাম্পের পাশে কবীরের মাদক স্পটে দিনে রাতে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা, ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। উত্তরা ৭ নং সেক্টরের বিজিবি মার্কেটের পেছনে ইসমাইলসহ আরো কয়েকজন বিক্রি করছে ইয়াবা। স্থানীয়রা জানান, প্রকাশ্যেই এসব স্পটে দিনে-রাতে মাদক বিক্রি হলেও রহস্রজনক কারণে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তুরাগ থানা এলাকার দিয়াবাড়ি, যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণখান থানা এলাকার ফায়দাবাদ মিজানের গ্যারেজে, ফায়দাবাদ কাঠালতলায় এবং দক্ষিণখান রেল লাইনের পাশে ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ সবধরনের মাদক বিক্রি হচ্ছে। এসব মাদক স্পট পুলিশের সহযোগিতায় মাদক ব্যবসায়ী আনিস, হীরু, গিটার মামুন, চাকমা সুমনসহ প্রায় ২০ জনের একটি মাদক বিক্রির সিন্ডিকেট রয়েছে।
গত কয়েকদিন সরেজমিনে দেখা গেছে, গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকায় কঠোর পুলিশ প্রহরা রয়েছে। রাস্তায় দফায় দফায় তল্লাশি এবং পথচারীদের চেকপোস্টে দাঁড় করে চলছে জিজ্ঞাসাবাদ। এছাড়া যানবাহ আটক করে চলছে ব্যাপক তল্লাশি। বিশেষ করে মোটর সাইকেল আরোহীদের দীর্ঘ সময় ধরে কাগজপত্র দেখার নামে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ফলে ওই এলাকায় বসবাসকারী ও পথচারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ভীতি।
পাল্টে গেছে রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ আশপাশের এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের চিত্র। হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর থেকেই এসব এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। খুচরা দোকান থেকে শুরু করে সুপারশপ, রেস্তোরাঁ, শপিংমল সবখানেই স্থবিরতা চলছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের ব্যবসা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ কমে গেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, গুলশানসহ আশপাশের এলাকার রেস্তোরাঁ ব্যবসা আগের অবস্থায় ফিরে আসতে অনেক সময় লাগতে পারে। কারণ, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে, তার থেকে কয়েকগুণ আতঙ্ক জনমনে তৈরি হয়েছে। এছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুরো গুলশান ঘিরে প্রশাসনের যে তৎপরতা এখন চলছে, তাতে মানুষ আরও বেশি ভয় পাচ্ছে।
শুধু গুলশান এলাকায় নয়, নিরাপত্তার কড়াকড়ির কারণে বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, ১১ ও ১২ নম্বর সড়কে অধিকাংশ সময় নীরব দেখা যায়। ১১ নম্বরে অবস্থিত বিভিন্ন ব্র্যান্ড, দেশীয় বুটিকসের দোকান, বিদেশি রেস্তোরাঁর সামনে পুলিশি প্রহরা রয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি অন্যান্য অপরাধ দমনেও পুলিশ ব্যস্ত আছে। তিনি বলেন, রাজধানীতে এখন অপরাধ অনেক কমেছে।
জঙ্গি দমনে জরুরীভিত্তিতে ২০ হাজার পুলিশ নিয়োগ দেয়া হচ্ছে
জঙ্গি দমনে এ বছরের মধ্যেই আরও ২০ হাজার পুলিশ নিয়োগ দেয়া হবে। সরকার এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জঙ্গি দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে এবং যে কোনো ধরনের সহিংস পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের নিয়োগ করা হবে। এসব পুলিশ সদস্যের হাতে থাকবে অত্যাধুনিক অস্ত্র। তাদের দেয়া হবে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ। পুলিশ সদর দপ্তর ও মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দেশব্যাপী জঙ্গি হামলার আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাবকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ হাজার নতুন পুলিশ নিয়োগের প্রস্তাব ছিল। এর মধ্যে ২০ হাজার নিয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়েছে গত বছর। আরও ২০ হাজার পুলিশ নিয়োগের প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে খুব দ্রুত এর অনুমোদন দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল আহছান জানান, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে পুলিশে তাদের নতুন জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বর্তমানে দেশের পুলিশ বাহিনীতে যে পরিমাণ জনবল রয়েছে সেটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
উপরন্তু সম্প্রতি গুলশান ও শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে জঙ্গি হামলার কারণে বিদেশিদের মধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তৈরি পোশাকের ক্রেতারা এখন তাদের দরদামের বিষয়গুলো নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হংকং ও সিঙ্গাপুরের মতো তৃতীয় কোনো দেশে আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন