চট্টগ্রামের নবনির্মিত বায়েজিদ বোস্তামি-ফৌজদারহাট সড়কের দুই পাশে পাহাড় কেটে তৈরি সাড়ে ৩শ’ বসতঘর দোকানপাট উচ্ছেদ হলেও এসব অবৈধ স্থাপনার মালিকদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। পাহাড় বিনাশকারী এসব ভ‚মিদস্যুদের চিহ্নিত করারও কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে তারা নতুন নতুন এলাকায় পাহাড় কেটে স্থাপনা তৈরির করছে। দখল করছে সরকারি জমি।
চট্টগ্রামে পাহাড় নিধনকারীরা এভাবেই পার পেয়ে যায়। পাহাড়খেকো এসব ভ‚মিদস্যুদের বিরুদ্ধে কঠোর কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাহাড় কাটা থামছে না। পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠা বসতির নামে মৃত্যুক‚পে এখনো কয়েক হাজার পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। নানা উদ্যোগ নিয়েও তাদের পাহাড় থেকে সরানো যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএ ১৫টি পাহাড় কেটে ছয় কিলোমিটার ওই সড়কটি নির্মাণ করে। একই সময়ে পাহাড় কেটে পাঁচ শতাধিক স্থাপনা গড়ে তোলে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক দলের ক্যাডার মাস্তান। গত ২৪ জুন ছয়জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে টানা অভিযানে সড়কের দুুই পাশের বেশিরভাগ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। তবে পাহাড় কেটে যারা বিনাশ করেছে তাদের কিছুই হয়নি। তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলাও হয়নি। অথচ সেখানে অভিযানের সময় এসব বসতঘর আর দোকান পাটে বিদ্যুতের সংযোগ এবং মিটারও পাওয়া যায়। ফলে দখলদারদের নাম ঠিকানা সরকারি দপ্তরেই আছে। ওই অভিযানে নেতৃত্বদানকারী পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক (উপ-সচিব) মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী বলেন, অভিযানে ৩৫০টি স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পাহাড় কেটেই এসব স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিলো। তবে কারো বিরুদ্ধে এখনও মামলা হয়নি।
কোথাও পাহাড় কাটার ঘটনা ঘটলে পরিবেশ অধিদফতর জরিমানা আদায় অথবা পরিবেশ আদালতে মামলা করে। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা তাদের নেই। তবে এ ক্ষেত্রে কিছুই করা হয়নি। আবার জরিমানা করা হলেও বেশির ভাগ সময় পাহাড়কাটায় জড়িতরা উচ্চ আদালতে গিয়ে ওই আদেশের বিরুদ্ধে রিট করে বসেন। সিডিএকে পাহাড় কাটার জন্য ১০ কোটি এবং ঠিকাদারকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। সিডিএ ওই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গেছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, আইনের দুর্বলতার এবং প্রশাসনের অভিযানে ধারাবাহিকতা না থাকায় পাহাড় কেটে যারা সাবাড় করে তাদের কিছুই হয় না। ফলে পাহাড় নিধনও বন্ধ হয় না। চট্টগ্রামে পানিবদ্ধতার মূলেই রয়েছে পাহাড় কর্তন। বিগত এক দশকে প্রতিবছর বর্ষার আগে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়া আর কিছু লোক দেখানো অভিযান হয়। তবে পাহাড় দখলে নিয়ে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলে যারা হতদরিদ্র মানুষের কাছ থেকে মাসে মাসে ভাড়া আদায় করেন তাদের কিছুই হয় না।
এসব অবৈধ বসত বাড়িতে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানি সরবরাহও দেওয়া হয়। বিভিন্ন সময় এরসাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিই শুধুই শোনা যায়। অতীতে সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পাহাড় কাটার সাথে সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, এমন কি পরিবেশ অধিদপ্তরের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরও কিছুই হয়নি।
এদিকে মহানগরীর আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন পাহাড়ে এখনও হাজার হাজার পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। গত তিন দিন ধরে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। নগরীর ১২টি পাহাড়ে অতিঝুঁকিতে থাকা কয়েকশ পরিবারকে সরিয়ে নিলেও তাদের কেউ সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি। গতকাল পর্যন্ত টানা তিন দিন মাইকিং করেও কাউকে পাহাড় থেকে সরানো যায়নি।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ে অতিঝুঁকিতে থাকা উপরে ও নিচের অংশের লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে রাজি না। তাই একটু কম ঝুঁকির অংশে প্রতিবেশীদের ঘরেই তারা অবস্থান করছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে তারা আশ্রয় কেন্দ্রে যাবেন না বলে জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় প্রতিবছরই পাহাড় ধ্বসে প্রাণহানি ঘটেছে। ২০০৭ সালের ১১ জুন টানা ভারী বর্ষণে মহানগরী ও আশেপাশের এলাকায় পাহাড় ধসে মাটিচাপায় ১২৯ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালের ১২-১৩ জুন রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে ১১০ জন, চট্টগ্রামে ২৩ জনসহ মোট ১৫৬ জন মারা যায়। এসব ঘটনায় কোন পাহাড় নিধনকারীর সাজা হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন