শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চামড়া নিয়ে ভানুমতির খেল আর নয়

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০২০, ১২:০১ এএম

কোরবানির চামড়া নিয়ে ভানুমতির খেল চলছে কয়েক বছর ধরে। পানির দামে চামড়া কেনার জন্য ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে গত কয়েক বছর ধরে অপকৌশলের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ ওপেন সিক্রেট। পরিণতিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ন্যায্য দামের চেয়ে দশ শতাংশ কিংবা তার চেয়ে কম মূল্যে তাদের কাছে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
কোরবানি যারা করেন তাদের সিংহভাগই চামড়া দান করেন এতিমখানা সংবলিত মাদরাসায়। চামড়া বিক্রির অর্থ দিয়ে এতিম ও গরিব শিক্ষার্থীদের সারা বছরের পড়াশোনা, খাওয়া ও অন্যান্য খরচ চলে। চামড়ার দামে ধস নামলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব ধর্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোরবানির আগে প্রতি বছর চামড়া কেনার জন্য সরকারি নির্দেশনায় ব্যাংকগুলো ট্যানারিগুলোকে ঋণ দেয়।

ট্যানারিগুলোর একাংশ এ ঋণ আত্মসাৎ করাকে কর্তব্য হিসেবে বেছে নেয়। ট্যানারিগুলো চামড়া কেনে আড়তদারদের কাছ থেকে। কিন্তু আড়তদারদের অর্থ সময়মতো শোধ না করা তাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আড়তদারদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ট্যানারি মালিকদের কাছে ১৫৩ কোটি টাকা পাবেন। কোরবানিকে সামনে রেখে সরকার ট্যানারিগুলোকে চামড়া কেনার জন্য ৬০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার নির্দেশনা দিলেও ব্যাংকগুলো এ টাকা ছাড়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে গত কয়েক বছরের মতো এ বছরও চামড়ার দামে ধস নামতে পারে এমন আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠছে। বাংলাদেশের চামড়ার এক বড় অংশ রপ্তানি হয় চীনে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীনে চামড়া কতটা রপ্তানি করা যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বাণিজ্য যুদ্ধ ও করোনার কারণে গত বছরের ৩০০ কোটি টাকার চামড়া স্টক হয়ে আছে।

চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রফতানিমুখী শিল্পখাত। যত মন্দাই হোক, এ খাত থেকে গত অর্থবছরেও বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় হয়েছে। দেশের চামড়া শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের শতকরা ৮৫ ভাগই বিদেশে রফতানি হয়, যা আন্তর্জাতিক বাজার চাহিদার শতকরা ১০ ভাগের বেশি পূরণ করে। গত এক দশকে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার মূল্য অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে যেখানে কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য ছিল প্রতি বর্গফুট ৯০ টাকা, সেখানে গত ৩ বছর ধরে তা ৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও প্রান্তিক বিক্রেতারা তা পায়নি।

শরিয়তের বিধান অনুসারে কোরবানির পশুর চামড়া বা এর মূল্যের হক এতিম ও হতদরিদ্র মানুষের। সিন্ডিকেটেড কারসাজি বন্ধ করতে এবং এতিম-মিসকিন ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার অন্যতম অবলম্বন হিসেবে কোরবানির চামড়ার ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার কোনা কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় দেশের লাখ লাখ এতিম, হাজার হাজার কওমী মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং ও গ্রামীণ জনপদের অসহায়-দরিদ্র মানুষকে অশেষ বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে। কোরবানির পশুর চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং এতিম-মিসকিন ও গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠির সামাজিক নিরাপত্তায় বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। কোরবানির পশুর চামড়ার মূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠির শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে।

কোরবানির পশুর চামড়া মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে ঢাকার আড়তে আসে। আড়তদাররা এসব চামড়া কিনে সাভারের ট্যানারি শিল্প নগরীতে সরবরাহ করে থাকেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী, ঢাকার আড়তদার ও ট্যানারি মালিক এই তিন পক্ষের মধ্যে বড় অঙ্কের লেনদেন হয়ে থাকে।

দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ পশুর চামড়া সংগ্রহ করা হয়, তার ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ আসে ঈদ-উল-আজহায়। কোরবানিতে ভালো ও সুস্থ গরু জবাই হয় বলে এই চামড়ার মানও ভালো থাকে। ব্যবসায়ীদেরও এই চামড়া সংগ্রহে আগ্রহ থাকে। চামড়ার দাম এবার আরও কমানোয় ট্যানারি মালিক ও এ শিল্প খাতে সংশ্লিষ্টরা লাভবান হলেও এতিম, অসহায়, এমনকি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।

কোরবানির চামড়া আমাদের দেশের সম্পদ। সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পের স্বার্থে কোরবানির চামড়া নিয়ে অসাধু বাণিজ্য বন্ধ করা জরুরি। দেশে চামড়ার দাম না পেলে চোরাই পথে পাচার হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। বর্ডার গার্ড বিজিবিকেও সতর্ক থাকতে হবে। চামড়ার বাজার উন্নত ও স্থিতিশীল রাখা জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থেই প্রয়োজন।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন