দিদারুল আলম রাজু, খাগড়াছড়ি থেকে : পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্যা বা ভূমি বিরোধ একটি অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী প্রধান সমস্যা। ভূমি বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যে পার্বত্য শান্তিচুক্তির আলোকে ১৯৯৯ সালের ৩রা জুন গঠিত হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এবং ব্রিটিশ শাসকদের ‘‘ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং জবমঁষধঃরড়হ-১৯০০”-সহ বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক প্রণয়নকৃত নিয়মনীতিগুলো আজ পর্যন্ত এই এলাকায় বিরাজমান ভূমি সমস্যার সমাধান দিতে পারেনি। ভূমি কমিশন গঠনের দীর্ঘ এই ১৭ বছরে প্রায় সাড়ে চার হাজার মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি একটি মামলাও। আর এর কারণ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ও বাঙালি ভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠনগুলো কমিশনের আইন এবং আইনের সংশোধনীকে প্রধান কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) বলছে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন কার্যকর না হওয়ার প্রধান কারণ ২০০১ সালের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন না হওয়া। তাদের অভিযোগ, আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)’র সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। এবং এর জন্যে জেএসএস চুক্তির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ আইনটির ২৯টি সংশোধনী দাবি করে আসছিলো দীর্ঘ বছর ধরে। এ নিয়ে একাধিক সরকারের মেয়াদে দীর্ঘ আলোচনাও হয়েছে। অরপদিকে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও নাগরিক পরিষদের অভিযোগ, ভূমি কমিশন আইনটি বৈষম্যমূলক। একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব বাদ দিয়ে শুধুমাত্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে কমিশনের বিচার কাজ কখনোই এ সংকটের সমাধান দিতে পারবে না। আর এই কারণেই ভূমি কমিশনের কার্যক্রম বরাবরই বিতর্কিত এবং অগ্রহণযোগ্য। এদিকে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের ১৪টি সংশোধনী ভেটিং সাপেক্ষে চুড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে আইনটিতে ২৩টি সংশোধনীর প্রস্তাব পাঠানো হয়। এরপর সেগুলো পর্যালোচনা করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ১৪টি সংশোধনী অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আগে পাঁচ সদস্যের কমিশন কোন বিরোধ নিষ্পত্তি করতে না পারলে কমিশনের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হতো। কিন্তু সংশোধনীর ফলে পাঁচ সদস্যের কমিশনে চেয়ারম্যান-সহ সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
আইনের সংশোধনীতে একটি নতুন ধারা সংযুক্ত করে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের দপ্তরে সচিব বা অন্যান্য কর্মকর্তার পদে উপজাতিদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর সেক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দারা অগ্রাধিকার পাবেন। নতুন করে আইন সংশোধনে পাহাড় জুড়ে শুরু হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আর এই কমিশনে চেয়ারম্যান ছাড়া অন্য চার সদস্য হলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট জেলার সার্কেল প্রধান, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এবং সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান।
তবে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি’র সভাপতি, সাবেক এমপি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিশনে কমিশনের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ছাড়া পৃথক ৩ জেলার ৩টি প্যানেলের বাকী তিন জন হলেন উপজাতী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে তাতে এক্ষেত্রে সরকার বা কমিশনের কোন নিয়ন্ত্রণই থাকবেনা। ফলে বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী বৈষম্যের স্বীকার হবে।’
এদিকে বরাবরই প্রতিটি সংশোধনীতে বাঙালি প্রতিনিধিত্ব উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, ‘সকল স¤প্রদায়ের সমান সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে কমিশন গঠন করা না হলে তা বরাবরেই মতোই বিতর্কিত এবং অকার্যকর হবে।’
আর নতুন সংশোধনীকে রাজনৈতিক কৌশল বলে দাবি করেছেন পার্বত্য চুক্তি বিরোধী পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’র কেন্দ্রীয় সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক নিরণ চাকমা। তিনি বলেন, ‘সংশোধনীর নামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে বোকা বানিয়েছে সরকার। নতুন সংশোধনীতে বলা হয়েছে পাঁচ সদস্যের কমিশনে চেয়ারম্যানসহ সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। চেয়ারম্যানসহ অর্থাৎ চেয়ারম্যান ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং শুধুমাত্র লেখার মারপ্যাচ দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছেই সর্বোচ্চ ক্ষমতা রেখে দেয়া হয়েছে।’
নতুন এই বিতর্ক এবং বিরোধীতার ফলে আবারো আগের কমিশনগুলোর মতোই এবারের কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিরসনে সমতার ভিত্তিতে পাহাড়ি ও বাঙালি সম্প্রদায়ের সমান সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে বিচারিক প্যানেল গঠন করতে হবে। নয়তোবা বরাবরের মতোই এবারের কমিশনও সফলতার মুখ দেখবেন না বলে মত দিয়েছেন অভিজ্ঞমহল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন