মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

স্বাস্থ্যে লুটপাট : দায় এবং চ্যালেঞ্জ

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২৯ জুলাই, ২০২০, ১২:০২ এএম

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ হয়েছে দেরিতে। টেস্ট করার কম সক্ষমতা, চিকিৎসায় দক্ষতার অভাব, ডাক্তার-নার্স-চিকিৎসাকর্মী স্বল্পতা, করোনা সমস্যার গভীরতা বুঝতে না পারা এবং জনগণের অসচেতনতা ইত্যাদি থাকা সত্তে¡ও দেশের সাধারণ জনগণ এটাকে নীরবে মেনে নিয়েছেন। তবে করোনার চাইতে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি মানুষকে চরমভাবে হতাশ ও বিস্মিত করেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্য খাতকে ‘সিন্ডিকেট বাণিজ্যমুক্ত’ করার অনুরোধপত্র পাঠিয়ে আলোচিত কেন্দ্রীয় ঔষধাগার-সিএমএসডির সাবেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহও হার মানেন করোনা ভাইরাসের কাছে। ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল -সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী পিপিই এবং মাস্ক কেনাকাটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পরিপ্রক্ষিতে গত ২৩ মে তাকে সিএমএসডি থেকে সেনাসদর দপ্তরে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ওই সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লেখা চিঠিতে তিনি সিএমএসডিসহ গোটা স্বাস্থ্য খাতকে ‘সিন্ডিকেটমুক্ত’ করার অনুরোধ জানিয়ে এক চিঠিটিতে লিখেছিলেন, স্বাস্থ্য খাতে ঠিকাদার চক্রের ইশারায় বদলি ও পদায়ন হয়ে থাকে। সিএমএসডি কেনাকাটাও তাদের কবজায়। চিঠিতে ঠিকাদারদের নামও উল্লেখ করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার শহীদুল্লাহ। অথচ তা সেই চিঠিটি আমলে নেয়া হয়নি এবং অ্যাকশন নেয়া হয়নি স্বাস্থ্যের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বা সাহেদ, সাবরিনা, শারমিন গোত্রের তথাকথিত কোনো ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। সেই বেদনা নিয়েই সিএমএসডি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সৎ-দক্ষ একজন দেশ প্রেমিক মানুষ ব্রিগেডিয়ার শহীদুল্লাহ।

অবশেষে অনেক পানি ঘোলা করে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই ধরতে হয়েছে সাহেদ, সাবরিনা, আরিফ, শারমীনদের। বিদায় নিতে হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি আবুল কালাম আজাদসহ কয়েকজনকে। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন মহা পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয় ডাঃ এ বি এম খুরশিদ আলমকে। একজন পরিচ্ছন পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে তিনি পরিচিত। এখন তিনি প্রথমে করোনার বিরুদ্ধে নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন, সেটা দেখার বিষয়। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে কাজ শুরু করে প্রথম দিনই মিডিয়াকে বলেছেন, স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির জন্য সবাই দায়ী। সরকার একা দায়ী নয়। এ কথা দিয়ে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা পরিস্কার হয়নি। কারণ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিকাদার সিন্ডিকেটের কুকর্মের জন্য ‘সবাই’ দায়ী হবেন কেন? বিষয়টি পরিস্কার করতে এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা জরুরি। যদিও তিনি একজন দক্ষ ও অন্তঃপ্রাণ চিকিৎসক, প্রশাসক হিসেবেও তার সাফল্য রয়েছে। কিন্তু যেই চ্যালেঞ্জে তিনি পড়েছেন, সেখানে কতটা সফল হবেন-এ নিয়ে তার হিতাকাক্সক্ষীদের মধ্যেও আশঙ্কা রয়েছে। টানা বেশ ক›বছরে অব্যবস্থাপনা ও দুর্ণীতির যে বলয় এই অধিদপ্তরে তৈরি হয়েছে, তা এক ডিজির পরিবর্তনে রাতারাতি পাল্টে যাবে, এমনটা আশা করা কঠিন। এছাড়া অদক্ষ ও চলমান দুর্নীতির মাঝে সফল হওয়ার মসৃণ পথ রয়েছে বলে মনে হয় না। শুধু সদিচ্ছা ও কৌশলেই জয়ী হওয়া যাবে না। কারণ, এখানে যুদ্ধ জয়ের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখা হয় না। এখানে স্ক্রিপ্ট লেখা হয় তামিল বা মালয় সিনেমার স্টাইলে। শুধু উপর মহলের সন্তুষ্টি ও ভাগবাটোয়ারার প্রয়োজনে। ফলে এখানে ভাগেযোগে মিলমিশ এবং জ্বি হুজুরই হয়ে যায় যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি। ধরে নিলাম, নতুন ডিজি নিজের পকেট ভারী করতে উদ্যোগী হয়ে দুর্নীতির নতুন ধারণা পুশ করবেন না বা বীজ বপন করবেন না, কিন্তু তিনি উপরের দুর্নীতির শিকার হয়ে চিড়েচেপ্টা হবেন না, এ নিশ্চয়তা কোথায়? কারণ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের নার্ভাস সিস্টেমে যে ডিভাইস ইনপুট করা আছে সেখানে স্বচ্ছতা নামে কোনো এপ্লিকেশনই নেই বললেই চলে। শুধু এখনই নয়, দীর্ঘকাল ধরেই দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি যেন শিকড় ঘেঁড়ে বসেছে। আর এই দুর্নীতি করোনা আরো স্পষ্ট করে দিয়েছে।

সম্প্রতি নকল-নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহের কারণে অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল নামে কোম্পানির চেয়ারম্যান শারমীন জাহানকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই মামলায় ডিবি পুলিশ শারমীন জাহানকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠালে রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। শারমীন জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসন শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে তিনি কর্মরত। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনার পরপর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। সরকারী চাকরিতে থেকেই অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল নামে সরবরাহকারী এ প্রতিষ্ঠানটি তিনি খুলেছেন। কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দেশের আরো বিভিন্ন সরকারী দপ্তরে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধক সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসকদের জন্য তার প্রতিষ্ঠান অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল সর্বমোট ১১ হাজার ‘এন-৯৫’ মাস্ক সরবরাহের কার্যাদেশ পাওয়ার পর প্রথম দুই দফায় ১৭৬০টি মাস্কসহ তৃতীয় ও চতুর্থ দফায় আরো ১৭শ’ মাস্ক সরবরাহ করে। যার বেশীর ভাগই মানহীন ও নকল। বিষয়টি যখন হাসপাতালের পরিচালক তাদের নজরে আনেন, তখন তারা নকল মাস্কগুলো বদলে দেন অথচ নতুন করে যেগুলো সরবরাহ করেন সেগুলোও ছিল মানহীন ও নকল। জানা যায়, কোনও স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ছাড়াই নিজস্ব লোকদের মাধ্যমে এসব কেনা হয়েছে। কোন টেন্ডার প্রক্রিয়া হয়নি, মান যাচাই না করে, যাচাই-বাছাই কমিটি ছাড়াই এসব কেনাকাটা করেছে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে করোনা ইউনিটে দায়িত্বরত প্রত্যেকেই দুই থেকে তিনটি করে এই মাস্ক পেয়েছেন। বিএসএমএমইউ’র করা মামলায় বলা হয়, নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করার কারণে সম্মুখ সারির কোভিড যোদ্ধাদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারতো। অবশ্য গ্রেফতারের আগে সব অভিযোগ অস্বীকার করে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন শারমীন জাহান। যেমনটি শুরু থেকেই দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনাও। এক্ষেত্রে শারমীনের ঘটনা কিঞ্চিত ভিন্ন। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের মহিলা ও শিশু বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহসম্পাদক হন। বর্তমানে দলে কোনও পদ-পদবি না থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নকল ‘এন-৯৫’ মাস্ক সরবরাহের করেন তিনি। বিএসএমএমইউ’র করা মামলার ঘটনা জানাজানি পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি গণমাধ্যমকে বলেছেন, শারমিন জাহান শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করলে অন্য কোথাও বিজনেস বা পার্টটাইম জব করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত করতে হয়। এক্ষেত্রে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে অবহিত করেছিলেন কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে খতিয়ে দেখার ঘটনা হলেও ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য খাতকে ‘সিন্ডিকেটমুক্ত’ করতে মরহুম ব্রিগেডিয়ার শহীদুল্লাহর অনুরোধপত্র ছিল এর সূত্রপাত, কিন্তু এখানে সাহেদ, সাবরিনারা একা নয়, আর গ্রেফতার হওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় চাকরি পাওয়া শারমীন জাহানও একা ছিলেন না। তারা এই খাতে সিন্ডিকেটের শরিক মাত্র। কেউই একা নন। তাছাড়া চোখের সামনে অপকর্মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতানোর সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করার মতো মানুষ খুব কমই রয়েছে।

স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতের দুর্নীতি এখন হঠাৎ বা আকস্মিকভাবে হচ্ছে না। বিশেষ করে স্বাস্থ্যের সিন্ডিকেট অনেকটা ওপেন সিক্রেট। এখানে বেশির ভাগ খুঁটির জোরেই হয়। ক্ষমতার এই দাপটে সাহেদ, সাবরিনা, শারমীনরা চোখের সামনে এলেও তাদের তালিকা বেশ দীর্ঘ। যেহেতু তারা খুঁটির জোরেই এতদূর এসেছে, তাই কোনো কারণে সেই খুঁটি সরে যাওয়াতেই তারা ধরা পড়েছে। মোট কথা এটা এই খাতে শুরুও নয়, শেষও নয়।
অবশেষে বলতে চাই, দেশে করোনা কালে মাস্ক-পিপিইসহ নকল সুরক্ষা সামগ্রী, নকল স্যানিটাইজারের পর টেস্টের নামে টাকা নিয়ে টেস্ট না করেই রিপোর্ট দেওয়ার মতো ঘটনায় সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এবং আস্থা এতট নেমেছে যে এখন ভ্যাকসিন নিয়েও সন্দেহ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যারা ভেকসিন বানাবেন তাদের ওপরও আস্থার সংকট তৈরি হতে পারে। টিকা বা ভ্যাকসিন কতদিন কার্যকর থাকবে এবং তার দাম কীভাবে নির্ধারণ করা হবে? কোন প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন তৈরির অনুমতি পাবে? তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৈজ্ঞানিকভাবে যাচাই করা হবে কিনা? দুর্নীতি ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে তারা ভ্যাকসিন ব্যবসার সুযোগ পাবেন কি না? এসব প্রশ্ন উঠলে অবাক হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। ফলে ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরি নিয়ে কিছু ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠবে কি না সে আশঙ্কা অমূলক নয়। তাছাড়া যেখানে জ্বি হুজুরই হয়ে যায় যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি সেখানে সব কিছুই সম্ভব।

এতো কিছুর পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন মহাপরিচালকের সাফল্য কামনা করছি এবং করতেই থাকবো। তবে কয়েকজনের অপকর্মের জন্য সবাইকে দায়ী করে নয়, যার দায় তাকেই নিতে হবে। কাউকে দায়মুক্তির চেষ্টা করতে গিয়ে সবাইকে দায়ী করা কাম্য হতে পারে না।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন