বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

হায়া সোফিয়া এবং ফিরে দেখা অতীত

ওমর খালেদ রুমি | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০২০, ১২:০৩ এএম

১৪৩২ সালের ৩০ মার্চ অটোম্যান সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। পুত্রের নাম রাখা হয় মুহাম্মদ। পাশ্চাত্যের কাছে তিনি মেহমেদ বা মেহমেত নামে পরিচিত হলেও নাম তার শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) এর নামের সাথে মিল রেখেই রাখা হয়। ১৪৪৪ সালে শাহজাদা মুহাম্মদের বয়স যখন মাত্র বার বছর তখন সুলতান মুরাদ তাকে সিংহাসনে বসান। কারণও ছিলো। বাইজান্টাইনিদের সাথে সুলতান তখন একটি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। আর এই চুক্তিই তাকে শান্তির ব্যাপারে আশাবাদী করেছিলো। সুলতান মুরাদ তাই কিশোর পুত্রকে সিংহাসনে বসিয়ে অবসর জীবনে চলে যান। কিন্তু কিশোর মুহাম্মদকে সিংহাসনে দেখে খ্রিস্টানরা আবারও ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে। সাথে সাথে অটোম্যান প্রাসাদের অনেক উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারীর সাথে কিশোর সুলতানের মতবিরোধও বাড়তে থাকে। মাত্র দু’বছর যেতে না যেতেই কিশোর সুলতান রাজকার্যের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন। ওদিকে ইউরোপের খ্রিস্টান শক্তিও আস্তে আস্তে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কিশোর সুলতান মুহাম্মদ পিতা মুরাদকে একটি পত্র লিখে তাকে পুনরায় সিংহাসনে বসার অনুরোধ করেন। মুরাদ লিখে পাঠান, তিনি আর এখন সুলতান নন। অতএব, তাকেই সাম্রাজ্য সামলাতে হবে। সুলতান মুহাম্মদও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি আবারও লিখলেন, যেহেতু আপনি আমাকে সুলতান বলেছেন তাই সুলতান হিসেবে আমি আপনাকে হুকুম করছি হয় আপনি এসে সিংহাসনে বসুন অথবা আমার সেনাবাহিনীতে প্রধান সেনাপতি হিসেবে যোগ দিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করুন। মুরাদ ফিরলেন। সিংহাসনেও বসলেন। ধীরে ধীরে সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে এলো। পরিস্থিতি শান্ত হলো।

১৪৫১ সালে মুরাদ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রাজধানী এদির্নেতে মারা যান। শাহাজাদা মুহাম্মদ তখন ২০ বছরের যুবক। পিতার মৃত্যুতে তিনি আবারও দ্বিতীয়বারের মতো সিংহাসনে বসেন। বাইজান্টাইন এবং ইউরোপের খ্রিস্টান শক্তি এবারও শাহজাদাকে অপরিপক্ক ভেবে ভুল করলো। অথচ শাহজাদা ততদিনে তার মহান শিক্ষক আক শামসুদ্দীন এর তত্ত্বাবধানে পরিপক্ক হয়ে উঠেছিলেন। সিংহাসনে বসে তিনি শক্ত হাতে সাম্রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। সবারই টনক নড়ে। কিন্তু কেউ কল্পনাও করতে পারেনি এই তরুণ তুর্কী এতোটা টনক নাড়িয়ে দেবেন।

ক্ষমতায় আরোহণের পর তার হৃদয়ে লালিত স্বপ্ন, যা তার মহান শিক্ষক আক শামসুদ্দীন দিনে দিনে তার অন্তরের গভীরে প্রোথিত করেছিলেন সেই কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি শুরু করেন। কারণ তখন থেকে প্রায় ৮০০ বছর আগে মহানবী (সা.) কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু তখনও সেই ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিফলন হয়নি। তিনি নিজেকে রসুলুল্লাহ (সা.) এর ভবিষ্যদ্বাণী সফল করার জন্য উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি শপথ করলেন, হয় কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়, না হয় মৃত্যু। তার অন্তরে সদা অনুরণিত হতে লাগল মহানবীর (সা.) মুখ নিঃসৃত বাণী, ‘কনস্ট্যান্টিনোপল বিজিত হবে। কতই না উত্তম সেই দলটি। আর কতই না উৎকৃষ্ট তার নেতা।’ মুসনাদে আহমদ।

অবশেষে ১৪৫৩ সালের ২১ মে সুলতান মুহাম্মদ মাত্র ২১ বছর বয়সে আল্লাহর অশেষ রহমতে কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের সৌভাগ্য লাভ করেন। ৬ এপ্রিল শুরু হওয়া এই যুদ্ধে ৫৩ দিনের টানা অবরোধ ও যুদ্ধের শেষে থিওডেসিয়াস দেয়াল দিয়ে ঘেরা তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপলের অবশেষে পতন হয়।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ইতোপূর্বে অজস্র বার কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের জন্যে মুসলমানরা জীবন বাজি রেখে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েছে। প্রথম অবরোধ যা ৬৭৪ থেকে ৬৭৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিলো, তাতে মুসলমানরা ব্যর্থ হয়েছিলো। এই অভিযানে মহানবী (সা.) এর মহান সাহাবী হযরত আবু আইয়ুব আল আনসারী (রা.)ও অংশগ্রহণ করেছিলেন। অবরোধ চলাকালে তিনি পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মারা যাওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, যদি এই অভিযান সফল হওয়ার আগেই আমার মৃত্যু হয় তবে তোমরা কনস্ট্যান্টিনোপলের যতটা কাছাকাছি সম্ভব আমার কবর দিও। কনস্ট্যান্টিনোপালের সেই বিখ্যাত থিওডেসিয়াস দেয়ালের কাছাকাছি হয়রত আবু আইয়ুব আল আনসারীর (রা.) কবর তখনও বহাল ছিলো।

দীর্ঘ অবরোধ চলাকালীন সময়ে যখন সুলতান মুহাম্মদ কোনমতোই কনস্ট্যান্টিনোপল জয় করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না, তখন তিনি তার ওস্তাদ বয়োবৃদ্ধ আক শামসুদ্দীনের শরণাপন্ন হন। আক শামসুদ্দীন তাকে বলেন, এই দেয়ালের আশে পাশে কোথাও হযরত আবু আইয়ুব আল আনসারী (রা.) এর কবর রয়েছে। আমাদের প্রথম সেই কবর খুঁজে বের করতে হবে। অতঃপর সুলতান মুহাম্মদ তার ওস্তাদ আক শামসুদ্দীন এবং সেনাপতিকে সাথে নিয়ে অত্যন্ত গোপনে এই কবর খুঁজতে বের হন। ময়দানে তখন তুমুল যুদ্ধ চলছিলো। অবশেষে তিনদিন খোঁজার পর তারা হযরত আবু আইয়ুব আল আনসারীর (রা.) কবর খুঁজে পান। কবর খোড়া হলে সাহাবী (রা.) এর কাফন উন্মুক্ত করা হয়। তার হাতের মুঠোয় তার স্বহস্থে লেখা একটা চিঠি। তাতে লেখা, ‘তোমরা কি কেউ আমাকে কনস্ট্যান্টিনোপলের মাটি এনে দেবে না?’

এই চিঠি পড়ার পর সুলতান এতোটাই আবেগাপ্লুত হন যে তিনি পনোর্দ্যমে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নেন। পরদিন সকালে তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে ফজরের সালাত নিজ ইমামতিতে জামাতে আদায় করেন। নামায শেষে তিনি সৈন্যদেরকে বলেন, ‘এই যুদ্ধ আমাদের আর বিজয় আল্লাহর’। হয় মৃত্যু, নয় বিজয়।

অবশেষে দিনভর তুমুল যুদ্ধের পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই সুলতানের মহান যোদ্ধা হাসান উলুবাটালিয়া কনস্ট্যান্টিনোপলের দুর্গের চূড়ায় অটোম্যান সালাতানাতের পতাকা ওড়াতে সক্ষম হন। অটোম্যান বাহিনী বিপুল বিক্রমে নগরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। যুদ্ধ শেষে দেখা যায় হাসানের শরীরে ৬টি গুলি আর ২৯টি তীর বিদ্ধ হয়ে আছে।

সুলতান মুহাম্মদ কনস্ট্যান্টিনোপলে প্রবেশ করলেন। প্রথমেই তিনি দু’হাতে কনস্ট্যান্টিনোপলের মাটি মাখালেন। তার পর পাগড়ি খুলে সেই মাটি মাথায় মাখালেন। মাটি এনে দিলেন সাহাবী হযরত আবু আইয়ুব আল আনসারী (রা.) এর কবরে। আর এভাবেই কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের সাথে সাথে ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত গ্রিক অর্থোডক্স গির্জা হায়া সোফিয়া মুসলমানদের দখলে চলে এসেছিলো। সুলতান মুহাম্মদ, যিনি কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয়ের জন্য মুহাম্মদ আল ফাতিহ নামে সারা পৃথিবীতে পরিচিত, তিনি এটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করলেন।

অবশ্য এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণের পর টানা ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এটি গ্রিক অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে পরিচিত ছিলো। কিন্তু ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে এটি ১২৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রোমান ক্যাথোলিক গির্জায় রূপান্তরিত হয়েছিলো। পরবর্তীতে ১২৬১ সাল থেকে ১৪৫১ সালে মুসলমানদের বিজয়ের আগ পর্যন্ত গির্জাটি আবারও গ্রিক অর্থোডক্স গির্জায় রূপান্তরিত হয়েছিলো।

এবার আসা যাক পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে। ১৪৫৩ সাল থেকে প্রায় পাঁচশ বছর অর্থাৎ ১৯৩১ সাল পর্যন্ত এটি মসজিদ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু ১৯৩৫ সালে মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক এটাকে যাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। ১৯৩৮ সালে কামাল আতাতুর্কের মৃত্যু হলেও এটি যাদুঘর হিসেবেই রয়ে যায়।

আর এভাবেই চলে আসাছিলো ২০২০ সাল পর্যন্ত। ২০২০ সালের শুরুতেই তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রেসিপ তাইয়েপ এরদোগান এটিকে পুনরায় যাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তরিত করার আইনী প্রক্রিয়া শুরু করেন। সারা বিশ্বে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিন্তু এরদোগান নাছোড়বান্দা। তিনি লেগে থাকেন।

অবশেষে ১৪ জুলাই আদালতের রায় হয় তারই পক্ষে। আর এই ফলে ৮৬ বছর পর গত ২৪ জুলাই প্রেসিডেন্ট রেসিপ তাইয়েপ এরদোগান তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে শুক্রবারের জুমার নামাজ আদায় করেন। প্রেসিডেন্ট তার এক বার্তায় বলেন, ১৯৩০ এর মাঝামাঝিতে এটিকে যাদুঘরে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্তটি নিতান্তই ভুল ছিলো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Faruqulalam. ১ আগস্ট, ২০২০, ৬:০২ পিএম says : 0
আমার মতে এরদোগানের সিদ্ধান্তই সঠিক কারণ পুরোদুনিয়াটাই আল্লাহর দেওয়া দান। সুতরাং সেখানে আল্লাহর তায়ালার প্রশংসা হবে এটাই স্বাভাবি।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন