শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

হজে তালবিয়া এবং এহরামের গুরুত্ব ও ফজিলত

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০২০, ১২:০৩ এএম

রাসুল সা. ইরশাদ করেন, যে হজ্জ দ্বারা পাপ থেকে পবিত্র হয়, জান্নাতই হল তার পুরস্কার। (বোখারী শরীফ) রাসুল সা. অন্য হাদিসে বলেন, এক উমরার পর আর এক উমরা করলে দুই উমরার মধ্যবর্তী সব গোনাহ মোচন হয়ে যায়। (মুসলিম শরীফ) তিনি আরো ইরশাদ করেন, একাধারে হজ্জ ও উমরা, পাপ ও দারিদ্রকে এমনভাবে মিটিয়ে দেয় যেমন আগুন লোহার ময়লা দূর করে দেয়। (কানযুল উম্মাল) উমরা কি ও কেন ঃ সাধ্য থাকলে জীবনে একবার উমরা করা সুন্নাতে মুআক্কাদা। মাত্র কয়েকটি আমলের সমষ্টিকে উমরা বলা হয়। যথা- ১। এহরাম বাঁধা। ২। বায়তুল্লাহ তওয়াফ করা। এটাকে তওয়াফে উমরা বলা হয়। ৩। সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সায়ী করা। ৪। সায়ী করার পর হলক (মাথা মুন্ডান) করে বা কছর (চুল ছোট) করে এহরাম খুলতে হয়।
যার উপর হজ্জ ফরয ঃ যার নিকট মক্কা শরীফ থেকে হজ্জ করে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের আবশ্যকীয় খরচ ছাড়া মক্কা শরীফ যাতায়াতের মোটামুটি খরচ পরিমাণ অর্থ থাকে তার উপর হজ্জ ফরয। ব্যবসায়িক পণ্য এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমির মূল্য এ অর্থের হিসেবে গণ্য করতে হবে। মেয়েলোকের জন্য নিজ স্বামী বা কোন বিশ্বশÍ দ্বীনদার মাহরাম পুরুষ ব্যতীত হজ্জে যাওয়া জায়েয নয়। অন্ধের উপর হজ্জ ফরয নয় যত সম্পদ থাকুক না কেন? নাবালেগের উপর হজ্জ ফরয নয়। নাবালেগ অবস্থায় হজ্জ করলেও বালেগ হযয়ার পর সম্বল হলে পুনরায় হজ্জ করতে হবে। হজ্জ ফরয হওয়ার পর বিলম্ব না করে হজ্জ ফরয হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে সেই বৎসরই হজ্জ করা ওয়াজিব। বিনা ওযরে দেরী করা পাপ। ছেলে মেয়ের বিবাহ শাদী দেয়ার জন্যে বা বাড়ি তৈরি করার জন্যে বিলম্ব করা কোন গ্রহণযোগ্য ওযর নয়। শেষ বয়সে হজ্জ ক্রিয়াদি ভালভাবে আদায় করা কঠিন হয়। হজ্জ ফরয হওয়ার পর আলস্য করে বিলম্ব করলে এবং পরে গরীব বা শক্তিহীন হয়ে গেলেও ঐ ফরয তার জিম্মায় থেকে যাবে-মাফ হবে না, যে কোন উপায়ে তাকে হজ্জ করতে হবে বা মৃত্যুর পূর্বে বদলী হজ্জ্বের ওছীয়ত করে যেতে হবে। মাতা-পিতা হজ্জের পূর্বে সন্তান হজ্জ করতে পারে না, এই ধারণা ভুল। অতএব এ ধারণার বশবর্তী হয়ে হজ্জে বিলম্ব করা গ্রহণযোগ্য ওযর নয়। হজ্জ ফরয হওয়া সত্তে¡ও যে হজ্জ না করে মৃত্যুবরণ করে, তার জন্য ভীষণ আযাবের সংবাদ দেয়া হয়েছে। এরূপ লোক সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে, সে ইহুদী হয়ে মরুক বা নাছারা হয়ে মরুক, আল্লাহর সঙ্গে তার কোন সংশ্রব নেই।

কোন প্রকার হজ্জ করা উত্তম ঃ হজ্জ তিন প্রকার (১) হজ্জে এফরাদ (২) হজ্জে কেরান (৩) হজ্জে তামাত্তু। এর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম, হজ্জে কেরান, তারপর হজ্জে তামাত্তু, তারপর হজ্জে এফরাদ।

এহরাম বাধাঁর পদ্ধতি ঃ এহরাম বাঁধার ইচ্ছা হলে প্রথমে ক্ষৌরকার্য করে নিন-নখ কাটুন, বগল ও নাভির নীচের পশম পরিস্কার করুন। এগুলো মোস্তাহাব। মাথা মুন্ডানোর অভ্যাস থাকলে মাথা মুন্ডিয়ে নিন অন্যথায় চুল আঁচড়িয়ে নিন। তারপর এহরামের নিয়তে গোসল করুন, না পারলে অযু করে নিন, এটা সুন্নত। ভালভাবে শরীরের ময়লা দূর করবেন। তারপর সেলাই বিহীন লুঙ্গি পরিধান করুন অর্থাৎ একটা চাঁদর পরিধান করুন। ডান বগলের নিচ দিয়ে পরবেন না। এহরামের কাপড় সাদা হলে উত্তম। পুরুষের জন্য এহরাম অবস্থায় শরীরের পরীমাপে সেলাই করা হয়েছে-এমন কাপড় পরিধান করা নিষিদ্ধ। মহিলাগণ যে কোন পোষাক পরিধান করতে পারেন। এহরামের কাপড় নতুন বা পরিষ্কার হওয়া উত্তম। তারপর সুগন্ধি দেয়া সুন্নত। তারপর এহরামের নিয়তে দুই রাকআত নফল নামায পড়ে নিন। এটা সুন্নত। এই দুই রাকআতের মধ্যে প্রথম রাকআতে সূরা কাফিরূন এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা এখলাস পড়া উত্তম। এই নামায মাথায় টুপি সহাকারে পড়তে হয়। নামাযের নিষিদ্ধ বা মাকরূহ ওয়াক্তে এহরামের নামায না পড়েই এহরাম বাঁধতে হয়। নামাযের পর টুপি খুলে রেখে কেবলামুখী থেকেই এহরামের নিয়ত করতে হবে। বসে বসেই নিয়ত করা উত্তম এবং নিয়ত মুখেও উচ্চারণ করা উত্তম। তারপর তালবিয়া পড়–ন। তালবিয়া পড়া সুন্নাত, তবে নিয়তের সাথে একবার তালবিয় বা যে কোন যিকির থাকা শর্ত। তালবিয়া জোর আওয়াজে পড়া সুন্নাত এবং তিনবার পড়া সুন্নাত। মহিলাগণ হায়েয নেফাসের অবস্থায় থাকলে নামায না পড়ে শুধু নিয়ত করে এবং তালবিয়া পড়ে নিলেই এহরাম হয়ে যাবে। মহিলাদের জন্য তালবিয়া জোর আওয়াজে পড়া নিষিদ্ধ, তারা এতটুকু শব্দে পড়বে যেন নিজের কানে শোনা যায়। তালবিয়া আরবীতেই পড়া উত্তম।

তালবিয়া ঃ লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্নি’মাতা, লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাক। অর্থ ঃ আমি হাজির হে আল্লাহ, আমি হাজির আমি হাজির, কোন শরীক নেই তোমার, আমি হাজির, নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই, আর সকল সাম্রাজ্যও তোমার, কোন শরীক নেই তোমার। এহরাম অবস্থায় যা করা বেশী উত্তম ঃ এহরাম অবস্থায় অধিক পরিমাণে তালবিয়া পড়া উত্তম। বিশেষত ঃ গাড়ীতে উঠতে, গাড়ী থেকে নামতে, কোন উঁচু স্থানে উঠতে, নীচু স্থানে নামতে, প্রত্যেক নামযের পর ইত্যাদি মুহুর্তে তালবিয়া পড়া মোস্তাহাব। তালবিয়া পুরুষগণ জোর আওয়াজে পড়বেন, তবে এত জোরে নয়, যেন নিজের বা কোন নামাযী বা ঘুমন্ত মানুষের অসুবিধে হয়। ঘর থেকে বের হওয়ার সময়, প্রবেশের সময়, সাক্ষাতের সময়, বিদায়ের সময়, উঠতে-বসতে, সকাল-সন্ধ্যায়, মোট কথা যে কোন ভাবে অবস্থার পরিবর্তন হলে সে সময়ে তালবিয়া পড়া মোস্তাহাব।
এহরাম অবস্থায় যা যা করণীয় ঃ নির্দিষ্ট পোষাক পরিধান পূর্বক (পুরুষের জন্য) হজ্জ অথবা ওমরাহ কিংবা হজ্জ ও উমরাহ উভয়টির নিয়ত করে বাইতুল্লাহ শরীফের তওয়াফ এবং সাফা-মারওয়ার সায়ী করার পর মাথা মগুন করে বা চুল ছোট করে মুক্ত হওয়া পর্যন্ত অবস্থাকে এহরাম বলে। যেখান থেকে এহরাম বাঁধে ঃ হজ্জ বা ওমরার উদ্দেশ্যে রওনা হলে মীকাত অর্থাত, শরীয়ত কর্র্তৃক এহরাম বাঁধার নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করার পূর্বেই এহরাম বেঁধে নেওয়ার জন্য জরুরি। বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান প্রভৃতী পূর্বঞ্চালীয় লোকদের জন্য এই নির্ধারিত স্থানটি হল ইয়ালামলাম (মক্কা থেকে দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত একটি পাহাড়ের নাম)। অবশ্যই এহরাম বেঁধে নিবেন। বিমান বন্দরে যেয়ে বা হাজী ক্যাম্প থেকে রওনা হওয়ার পূর্বে বাসায় বা মসজিদে যে কোন জায়গায় এহরাম বাঁধা যায়। যারা মদীনা শরীফ আগে যাওয়ার ইচ্ছা করবেন, তারা বিনা এহরামে রওনা হতে পারে। মদীনা যিয়ারতের পর যখন মক্কা শরীফ-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন, তখন মদীনা থেকে মক্কা শরীফ গমনকরীদের মীকাত যেহেতু যুলহুলাইফা তাই যুলহুলাইফা নামক স্থান থেকে বা মদীনা থেকেই এহরাম বেঁধে মক্কা শরীফে রওনা হবেন। যারা মদীনা শরীফে খেকে নফল উমরা করতে চান এহরাম বাঁধার জন্যে তাদেরকে হারামের সীমানার বাইরে যেয়ে এহরাম বেঁধে আসতে হবে। এর জন্য সবচেয়ে উত্তম স্থান হল তানয়ীম। বর্তমানে সেখানে মসজিদে আয়েশা নামক একটি মসজিদ আছে। সেখানে গিয়ে এহরাম বেধেঁ এসে নফল উমরা করবেন। জে’রেনা নামক স্থান থেকেও এহরাম বেঁধে আসা যায়।

এহরাম অবস্থায় যা যা বর্জনীয় ঃ পুরুষের জন্য শরীরের পরিমাপে বানানো হয়েছে- এমন সেলাই যুক্ত পোশাক নিষিদ্ধ। যেমন জামা, পায়জামা, টুপি, মোজা ইত্যাদি। মহিলাদের জন্য হাত মোজা, পা মোজা, অলংকার পরিধান করা জায়েয । মহিলাদের জন্য মাথা ঢাকা রাখা ওয়াজিব। এমন জুতা পরিধান করা নিষিদ্ধ, যাতে পায়ের মধ্যবর্তী উচুঁ হাড় ঢাকা পড়ে যায়। মহিলাগণ এরূপ জুতা পরতে পারে। সুগন্ধি যুক্ত সাবান ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ। নখ, চুল, পশম কাটা ও কাটানো নিষিদ্ধ। স্থাল ভাগের প্রণী শিকার করা বা সে কাজে কোন রূপ সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ। তবে মশা, মাছি, ছারপোকা, সাপ, বিচ্ছু ইত্যাদি কষ্টদায়ক প্রাণী মারা জায়েয। স্ত্রী সহবাস বা এতদসম্পর্কিত কোন আলোচনা করা নিষিদ্ধ। ঝগড়া বিবাদ করা বা কোন গোনাহের কাজ করা নিষিদ্ধ। এগুলো এমনিতেও নিষিদ্ধ। এহরাম অবস্থায় আরও কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। উকুন মারাও নিষিদ্ধ।

এহরাম অবস্থায় যা যা মাকরূহ ঃ শরীরের ময়লা পরিস্কার করা মাকরূহ। চুল, দাড়ি বা শরীরে সাবান লাগানো মাকরূহ। চুল বা দাড়িতে চিরুনি ব্যবহার মাকরূপ। এমনি ভাবে চুলকানো মাকরূহ, এহরামের কাপড় সেলাই করে বা গিরা কিম্বা পিন ইত্যাদি দিয়ে আটকানো মাকরূহ, তবে কোমরে বেল্ট বাঁধা জায়েয। টাকার থলি রাখাও জায়েয। বালিশের উপর মুখ দিয়ে উপুড় হয়ে শয়ন করা মাকরূহ। সুগন্ধি যুক্ত খাদ্য যদি পাকানো না হয় তবে তা খাওয়া মাকরূহ। পাকানো হলে মাকরূহ নয়। নাক গাল কাপড় দিয়ে ঢাকা মাকরূহ, তবে হাত দিয়ে ঢাকা যায়। ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন সুগন্ধির ঘ্রাণ নেয়া মাকরূহ। এলাচি, লুঙ্গি বা সুগন্ধিযুক্ত তামাক/জর্দা সহকারে পান খাওয়া মাকরূহ। আল্লাহ তাআলা সকলের হজ্জ কবুল করুন এবং সবাইকে হজ্জ করার তাওফিক দান করুন, আমিন
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক- জামিয়া ইসলামিয়া বায়তুল করিম চট্টগ্রাম

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
abdurrahman ৩১ জুলাই, ২০২০, ৯:২৮ এএম says : 0
লাব্বাইক...
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন