বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ব্রেকিং নিউজ : ‘বাড়ছে পুরুষ নির্যাতন’

প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : কেস স্টাডি- এক : ভারতীয় টিভি চ্যানেল স্টার জলসা দেখা নিয়ে ছুরিকাঘাতে স্বামীকে হত্যার দায়ে স্ত্রী নাহিদা আকন্দ রিপাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে আদালত। গতকাল গাজীপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক একেএম এনামুল হক এই রায় দেন। দ-প্রাপ্ত রিপা গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার ঘাগটিয়া এলাকার সোহরাব হোসেনের স্ত্রী। ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে রিপা টিভিতে স্টার জলসা দেখছিল। স্বামী সোহরাব হোসেন রিপাকে স্টার জলসা দেখতে নিষেধ করেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়ার এক পর্যায়ে রিপা সোহরাবকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এ ঘটনায় নিহতের বাবা শাহজাহান বাদী হয়ে জয়দেবপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করলে আদালত এ রায় দেয়।
কেস স্টাডি- দুই : জনৈক সরকারি চাকুরে ঈদে বাবা-মা-ভাই-বোনের কাপড় কেনার জন্য ৫ হাজার টাকা পাঠান। ওই টাকা অপ্রতুল হওয়ায় স্ত্রীর অগোচরে আরো ৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। ঈদের আগের রাতে সে টাকার খবর জানতে পেয়ে স্ত্রীর অগ্নিমূর্তি। কেন আমার অগোচরে টাকা পাঠানো হলো? তোমার বাবা-মা’র এতো টাকার প্রয়োজন কেন? শুধু প্রশ্ন নয়, স্ত্রী’র দাবি তার বাবা-মায়ের জন্য ১০ হাজার টাকা পাঠাতে হবে; না হলে ঈদের দিন চুলায় হাঁড়ি উঠবে না। বেচারা স্বামী তার আর্থিক সংগতি না থাকায় ঈদের আনন্দ প-। ঈদের দিন সেমাই খাওয়া দূরের কথা বাসায় রান্নাই ছিল বন্ধ।
পুরান ঢাকার এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম জাতীয় সংসদে নারীদের হাত থেকে পুরুষদের রক্ষার জন্য একটি আইন করার দাবি জানিয়েছিলেন। তার পুরুষ নির্যাতন আইন প্রণয়নের দাবি নিয়ে সংসদে হাসাহাসি হয়েছে। দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট মহাপ-িতের মতো হাজী সেলিমকে উপহাস করেন। তাদের ভাবখানা পুরুষ আবার নির্যাতন হয় নাকি? প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক মনা হতে গেলে নারী স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিতে হবে। পৃথিবীতে পুরুষ নির্যাতন বলে কোনো বিষয় থাকতে পারে না। অথচ যারা বেসরকারি টিভি বাংলাভিশনের প্রতি শুক্রবার রাতে মেহতাব খানমের ‘এখন আমি কী করবো’ অনুষ্ঠান দেখেন তারা জানেন; শুধু নারী নির্যাতন নয়; দেশে পুরুষ নির্যাতন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। ওই অনুষ্ঠানে গত কয়েক মাসে অনেক চাকরিজীবী পুরুষ তার স্ত্রী’র হাতে নির্যাতনের করুণ কাহিনী তুলে ধরেছেন। আমার লেখার শিরোনাম দেখে কেউ যদি হাসি-ঠাট্টা করেন এবং অবাক হন, তারা নিজেদের আশপাশে একটু তাকিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন পুরুষ নির্যাতন কোন পর্যায়ে গেছে। আজকের এই শিরোনাম কেবলই হাসি-ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেয়ার বিষয় নয়। সত্যিকার অর্থেই দেশে পুরুষ নির্যাতন বাড়ছে এবং সেটা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে গেছে। এমনকি দেশের রাজনীতির সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছেন, এক সময় রাষ্ট্র চালিয়েছেন, মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন এবং এখনো রয়েছেন- এমনো অনেক পুরুষ ঘরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সামাজিক অবস্থান ও লোকলজ্জার ভয়ে কেউ তা প্রকাশ করছেন না। স্ত্রী’র আদেশ-নির্দেশ পালন করা নিয়ে অনেক বিশিষ্টজনকে চরম অপমান হজম করতে হয়েছে। বাংলাভিশনের অনুষ্ঠানে এমনো পুরুষ তার নির্যাতনের কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন। আবার কেউ কেউ স্ত্রী সন্ত্রাসী ভাড়া করে স্বামীকে পিটিয়েছেন এমন কাহিনীও তুলে ধরেন। তবে সামগ্রিক ভাবে দেখা গেছে, পুরুষ নির্যাতন যত না শারীরিকভাবে হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে মানসিকভাবে। সমাজের নীচ-তলা উপর-তলাই শুধু নয়, সর্বস্তরেই পুরুষ নির্যাতনের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছেই। সমাজে এমনো পুরুষ রয়েছেন এবং বর্তমানে জনপ্রতিনিধি বাইরে নিজেদের ক্ষমতা অনেকভাবে জাহির করার চেষ্টা করলেও ঘরে তিনি কার্যত স্ত্রীর কর্মচারীর মতোই জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এবং বিভিন্ন পেশাজীবীর খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেছে, বিবাহিত পুরুষদের অধিকাংশই তাদের স্ত্রী’র অত্যাচারে নিরীহ জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত। স্ত্রীরা নিজ স্বামীকে শুধু দৌড়ের ওপর রাখতে অভ্যস্ত। ‘ওদিকে তাকালে কেন, ওখানে গেলে কেন, ওটা করলে কেন, অমুক ভাবীর এই জিনিসটা আছে আমার নেই কেন, ওরা প্রতিমাসে মার্কেটে যায় আমি পারি না কেন, আমার ভবিষ্যৎ কী শাড়ি-চুড়ি-গয়নার বায়নায় স্বামী বেচারার হয় দফারফা। আর যেসব পুরুষ পিতামাতা ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি একটু দুর্বল তাদের অবস্থা আরো খারাপ। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের স্ত্রী’র শাসনে তটস্থ থাকতে হয়। স্ত্রীর চাহিদা এমন যে তারা মনে করেন স্বামীর কাছে আলাউদ্দিনের চেরাগ আছে। চাইলেই টাকা পয়সা, সোনা-রুপা, হীরে জহরত এসে যাবে। কয়েকজন সরকারি চাকুরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ঘুষ খেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন শুধু স্ত্রী’র চাহিদা মেটানোর জন্যই। ঘুষ খেয়ে চাকরি হারিয়েছেন এমন ঘটনাও রয়েছে। অধিকাংশ পুরুষই অসৎ ভাবে রুজি করেন স্ত্রীর চাহিদার যোগান দিতেই। স্ত্রী যদি স্বামী সামর্থ্য অনুযায়ী যে অর্থ এনে দেয় তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, তবে সন্তানরাও সেটাতে অভ্যস্ত হন। স্ত্রী যদি স্বামীকে ঘুষ খেতে কিংবা দুর্নীতি করতে বাধা দেন; তবে সংসারের শান্তির জন্য হলেও স্বামীটি ‘ঘুষ খাওয়া’ থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু অমুক ভাবির এতো টাকা মার্কেট করেন, তমুক ভাবি এটাওটা কিনেছেন, ওদের গাড়ি আছে ইত্যাদি চাহিদা দেখালে সংসারে অশান্তি এড়াতেই স্বামীরা বিপথে পা বাড়াতে বাধ্য হন।
যৌতুক আমাদের জাতীয় সমস্যা। যৌতুকের বলী হন নারীরাই। যৌতুককে ঘৃণা করা উচিত। আমাদের রাষ্ট্রের এবং রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নারীদের হাতেই। নারীর অধিকার আদায়ের জন্যই সাংবিধানিকভাবে জাতীয় সংসদে ৫০জন নারীকে সংরক্ষিত আসনে এমপি করা হয়। কিন্তু কোনো মহিলা এমপি দেশ এবং সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা বন্ধে কঠোর আইন করার দাবি সংসদে করেছেন এখন শোনা যায়নি। সমাজে নারী নির্যাতন অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু পুরুষ নির্যাতন শুরু হয় বিয়ের সময় থেকেই। বিয়ের সময় দেখা যায়, বরের যতটুকু দেনমোহর দেয়ার সাধ্য তার থেকে কয়েকগুণ বেশি করে দেনমোহর ধরা হয়। বিয়ের দেনমোহর ধার্য করার ক্ষেত্রে বরের সামর্থ্য, কনের শিক্ষাগত যোগ্যতা, রূপ, গুণ, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান কোনোটাই ধর্তব্যে নেয়া হয় না। বিয়ের পরে যেন সহজে বিয়ে না ভাঙে এবং যদি ভেঙ্গে যায় তাহলে মোটা অংকের টাকা স্ত্রীর হাতে তুলে দিতে বাধ্য থাকবে; এমন ভাবনা থেকে জোর করে দেনমোহরের বোঝা বরের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এতে বিয়ে শুরুই হয় দর-কষাকষি দিয়ে; সংসার জীবনে সে দর-কষাকষি থেকেই যায়। আসলে সমাজে নারী নির্যাতন এতো বেশি যে পুরুষ নির্যাতনের খবরগুলো তার আড়ালে ঢাকা পড়ে। আর সামাজিক অবস্থান এবং লোক-লজ্জার বিষয়তো রয়েছেই। আবার পুরুষ নির্যাতনের সব খবর প্রকাশ পায় না। তাছাড়া মিডিয়ার কাটতি, আইনগত সুবিধা ও সংবাদের বাজারমূল্য এখনও এদেশের নারীদের একতরফা দখলে। পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রযন্ত্রও এখন পর্যন্ত পুরুষ নির্যাতনের বিষয় কল্পনাও করে না। একজন নারী তার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ আনলেই সবাই সেটা বিশ্বাস করেন। আর দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর হাতে স্বামী (পুরুষ) নির্যাতনের খবর কালেভদ্রে প্রকাশ পেলেও মানুষ তা বিশ্বাস করতে চায় না। আবার নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এমন কিছু আইন রয়েছে যে, পুরুষরা কার্যত অসহায়। আদালতে বিচারের রায় নির্ভর করে নারীর বক্তব্যের ভিত্তিতেই।
নারী পুরুষ বা স্বামী-স্ত্রী মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। সংসার এবং যাপিত জীবনে উভয়েই উভয়ের পরিপূরক। নারী নির্যাতন হোক আর পুরুষ নির্যাতন হোক এগুলো আসে মানবিকতার অভাব থেকে। নির্যাতন কেউ পছন্দ করে না। তা কাম্যও নয়। সেটা নারী নির্যাতন আর কিংবা পুরুষ নির্যাতন যাই হোক না কেন। চাই নারী-পরুষ ও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কগুলো মানবিক হোক। পরশ্রীকাতরতা, লোভ, চাতুর্য, ঈর্ষার বদলে একে অপরের আবেগকে সম্মান জানানো শ্রেয়। সংসারে পরস্পরের জন্য সম্মানীয় একটি অবস্থান তৈরি হলে সন্তানরা তা দেখে শিখবে। সেটা না করে নারী পুরুষে একে অন্যের ওপর নির্যাতন সংসারে শুধু অশান্তিই বাড়ায় না; পারিবারিক বন্ধন আলগা করার পাশাপাশি হুমকির মুখে ঠেলে দেয় সন্তানদের ভবিষ্যৎ। শিশুরা যা দেখে তাই শেখে। এ জন্য সবার জন্য আইন সমান হওয়া উচিত। অথচ নারী (স্ত্রী) নির্যাতন আইনের অপব্যবহার করে পুরুষকে (স্বামী) করে রাখা হয়েছে তাদের অনুগত ভৃত্য। এসব প্রতিরোধে সচেতনতা এবং প্রতিরোধের অভাবে উৎপীড়ন, নিপীড়ন ও নির্যাতন পুরুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। লোকলজ্জা ও সামাজিক অবস্থানের কারণে অজানাই থেকে যাচ্ছে নারীর হাতে পুরুষ নির্যাতনের অসংখ্য লোমহর্ষক কাহিনী। অথচ হাজী সেলিমের প্রস্তাব যারা হালকাভাবে নিয়েছেন তারা কি প্রকৃত চিত্র তলিয়ে দেখেছেন? সমাজে যেভাবে পুরুষ নির্যাতন বাড়ছে তা উপেক্ষা করার পর্যায়ে নেই।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন