বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি এক বছরে আটক ২০৫ আমদানি চালান থামছে না বন্ড সুবিধার অপব্যবহারও

প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির হিড়িক পড়েছে। এর মাধ্যমে বিশাল অংকের রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। মিথ্যা ঘোষণায় আনা হাতে গোনা কিছু চালান ধরা পড়লেও বেশির ভাগ নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে। এতে সরকার বছরে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা এই জালিয়াত চক্রের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এই কারণে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা বেশিরভাগ চালান ধরা পড়ছে না।
শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই এমন চালান আটক করা হয়। গেল অর্থ বছরে মিথ্যা ঘোষণায় আনা ২০৫ টি চালান ধরা পড়েছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অভিযানে আটক এসব চালানে ৯০ কোটি ৩ লাখ ৯১ হাজার ৯১০ টাকার পণ্য আটক করা হয়েছে। এসব পণ্য আমদানির মাধ্যমে ২৬ কোটি ৪৬ লাখ ৫০ হাজার ২২১ টাকার শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছিল। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০৫ টি মামলা রুজু হয়েছে।
বন্ড সুবিধার আড়ালেও শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। বন্ড সুবিধায় আনা কাঁচামাল খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। আবার বন্ড সুবিধায় আনা কাঁচামালে তৈরী পণ্য বিদেশে রফতানির বদলে বিক্রি করা হচ্ছে দেশের বাজারে। গেল অর্থবছরে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের কারণে মামলা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আমদানিকৃত ৭৯ কোটি ৮৪ লাখ ১২ হাজার ৮৫১ কোটি টাকার পণ্য আটক করা হয়। এর মাধ্যমে ৩১ কোটি ২৪ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।
কাস্টম হাউস সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির হার বেড়েছে। যন্ত্রাংশের ঘোষণা দিয়ে মেশিনপত্র নিয়ে আসা হচ্ছে। কম শুল্কের পণ্যের ঘোষণা দিয়ে বেশি শুল্কের পণ্য আনা হচ্ছে। আর এর মাধ্যমে মোটা অংকের শুল্ক ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা জানান, এধরনের মিথ্যা ঘোষণায় আনা চালান ধরতে হলে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেতে হয়। তথ্য ছাড়া কোন চালান যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয় না।
কোন সূত্রে তথ্য পাওয়ার পর আমদানি পণ্য প্রথমে আটক করা হয়। পরে সংশ্লিষ্ট সবার উপস্থিতিতে এসব আমদানি পণ্যে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। আর তখনই কেবল মিথ্যা ঘোষণার বিষয়টি ধরা পড়ে। জালিয়াত চক্র শুল্ক ফাঁকি দিতে আমদানি পণ্যে এইচএস কোড জালিয়াতিও করছে। এইচএস কোড পরিবর্তনের কারণে কোন কোন পণ্যের আমদানি শুল্কের ব্যাপক তারতম্য হয়। কোড পরিবর্তনের মাধ্যমেও শুল্ক ফাঁকির একাধিক চালান আটক করা হয়েছে। আবার ওজনে তারতম্যের মাধ্যমেও শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা হচ্ছে। একশ’ টন পণ্য আমদানির কথা বলে তার বেশি পণ্য আনা হচ্ছে। এ ধরনের বেশিরভাগ চালান নিরাপদে পার হয়ে যায়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এসব শুল্ক ফাঁকির ঘটনা উদঘাটনে কাজ করে। গত ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকির ২০৫টি ঘটনা ধরা পড়ে। গেল জুন মাসে এমন ২৭টি ঘটনা ধরা পড়েছে। এসব চালানের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১০ কোটি ২১ লাখ ৮৩ হাজার ২৮৫ টাকার শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা হচ্ছিল। তার আগে মে মাসেও সমান সংখ্যক চালান আটক করা হয়। এপ্রিলে ১৬টি, মার্চে ১১টি, ফেব্রুয়ারীতে ৯টি, জানুয়ারীতে ১৪টি, ডিসেম্বরে ১৫টি, নভেম্বরে ৩২টি, অক্টোবরেও ৩২টি চালান আটক করা হয়। সেপ্টেম্বরে ৪টি, আগস্টে ৫টি এবং জুলাই মাসে ১৩টি চালান আটক করা হয়।
এসব ঘটনায় আটক করা হয় ৯০ কোটি ৩ লাখ ৯১ হাজার ৯১০ টাকার আমদানি পণ্য। এর মাধ্যমে ২৬ কোটি ৪৬ লাখ ৫০ হাজার ২২১ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা করা হচ্ছিল। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির মাধ্যমে শুল্কের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের করও ফাঁকি দেওয়া হয়।
এদিকে বন্ড সুবিধার আড়ালেও অনেক প্রতিষ্ঠান জালিয়াতি করে শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে। এমন ঘটনায় গেল অর্থবছরে দেশের ১৮টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। আবার কেউ বন্ড সুবিধার আওতায় আমদানিকৃত কাঁচামাল দ্বারা উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি না করে দেশের বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যেসব পণ্য আমদানির সুযোগ পাওয়ার কথা নয়, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বন্ড সুবিধার আওতায় সেসব পণ্য নিয়ে এসেছে। ফেডারেল করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে শর্ত লঙ্ঘন করে আর্ট পেপার নিয়ে আসে। তাদের বিরুদ্ধেও বন্ড মামলা হয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক এস এম শামীমুর রহমান বলেন, আগের অর্থ বছরের তুলনায় গত অর্থ বছরে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি চালান আটকের ঘটনা বেড়েছে। সেই সাথে রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে। এনবিআর ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের নজরদারি ও সঠিক নির্দেশনার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। যারা মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি দিতে অভ্যস্ত তারা তাদের কৌশলও পরিবর্তন করছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই কারণে আমাদেরও ফাঁকি ধরতে পাল্টা কৌশল নিতে হচ্ছে। আমাদের কাজের পরিধি বাড়ছে, তবে সে অনুপাতে লোকবল আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা বাড়ছে না। এতে কাজের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে বলেও জানান। তবে শুল্ক ফাঁকি রোধে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তৎপর রয়েছেন বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস গত অর্থ বছরে ৩১ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। রাজস্ব আদায়ের হার প্রতিবছরই বাড়ছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর খাতের একক বৃহত্তম সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণকারী প্রতিষ্ঠান। দেশের আমদানি বাণিজ্যের ৫৩ শতাংশ ও রফতানী বাণিজ্যের ৮৫ শতাংশ কার্যক্রম চট্টগ্রাম বন্দর এবং এই শুল্ক ভবনের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্বের ২৩ শতাংশ এই দপ্তর আহরণ করে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন