শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সিনহাকে বনানী কবরস্থানে দাফন

একজন বীরের রক্ত এবং মায়ের অশ্রু বৃথা যেতে পারে না : মা নাসিমা আক্তার আমার ভাই জীবনে একটা সিগারেট পর্যন্ত খায়নি : সিনহার বোন হত্যার দায় সিনহা ও সিফাতের ওপর চাপিয়েছে পুলিশ

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০২০, ১২:০০ এএম

সেনাবাহিনীর সদস্যরা পরেন এমন পোশাক পরা এক ব্যক্তিসহ দুজন মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস সে খবর আগেই পেয়েছিলেন। তার নির্দেশেই শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে যানবাহন তল্লাশির কাজ শুরু হয়। মৃত্যুর দায় চাপানো হয়েছে সিনহা ও তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতের ওপর। টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত ওই ঘটনায় যে মামলা করেছেন, সেখানেই পাওয়া গেছে এসব তথ্য। পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সিনহাকে বনানী কবরস্থানে দাফনঃ বনানীর সামরিক কবরস্থানে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। গত সোমবার তার দাফন সম্পন্ন হয়। এ সময় সেনা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মেজর (অব.) সিনহার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিলেন।

একজন বীরের রক্ত এবং মায়ের অশ্রæ বৃথা যেতে পারে না-মা নাসিমা আক্তার
মেজর (অব.) সিনহার মা নাসিমা আক্তার বলেছেন, আমার ছেলে বাস্তবের একজন নায়ক ছিল। সে সাহসের সাথে মৃত্যুকে বরণ করেছে। সে কোনো কাপুরুষ ছিলো না। একজন জাতীয় বীর ছিল। সে ছিল একজন সত্যিকারের প্রেরণাদাতা। আমাদের সকল আত্মীয়, সব বন্ধু তার কাছ থেকে জীবনের উৎসাহ পেতো। সে সবসময়ই হাস্যজ্জল এক চমৎকার মানুষ ছিল, যে সবসময়ই মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে এবং অন্যদের সুখী করতে চেষ্টা চালাতো। অপরের সুখের জন্য জীবন উৎসর্গ করাই ছিল তার অন্যতম ব্রত। সে ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। দেশকে যে নিজের চেয়ে বেশী ভালোবাসতো। আমার ছেলে ছিল দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সে সমুদ্র্র ভালোবাসতো। সমুদ্র সৈকতে বই পড়তে পড়তে সময় কাটাতে চাইতো। শৈশব থেকেই আমার ছেলে অ্যাডভেঞ্চারের প্রিয় ছিল। সারাবিশ্ব ভ্রমণের এক প্রগাঢ় সাধ ছিলো তার, যে জন্য সামরিক বাহিনী থেকে সে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিল। আমি তাকে নিষেধ করি নাই। তার হিমালয়ে যাবার স্বপ্ন ছিল। ছেলেটা হাইকিং পছন্দ করতো, জাপানে একটা সাইকেল ট্যুরে যেতে চেয়েছিলো। চাকুরি থেকে অবসরের পরপরই সে তার এই স্বপ্নগুলো ছোঁয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।

তিনি আরো বলেন, এর মাঝে করোনা মহামারি চলে এলো। দেশব্যপী লকডাউন শুরু হবার কদিন পরে সে জানালো যে, তাকে নিয়মিতই বাহিরে যাতায়াত করতে হয় এবং আমি একজন বয়স্ক মানুষ, তাই তার এই চলাফেরা আমার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এরপর সে বলল যে, রাজশাহী যাবে কিছুদিনের জন্য, সেখানে তার এক বন্ধুর মা (যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন) এক বিশাল লাইব্রেরী করেছেন। ছোট থেকেই সে প্রচুর বই পড়তো। তাই তাকে আমি যেখানে যেতে দিলাম। বললাম প্রচুর পড়াশোনা করতে। যখন সে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে ছিল, ছুটিতে বাংলাদেশে আসতো না। তার বদলে দুই মাসের ছুটিতে ইউরোপ যেয়ে গাড়ী করে হাজার হাজার মাইল ড্রাইভ করে নিজে নিজে ঘুরেছিল। এটা আমার খুব ভালো লেগেছিল কারণ ছেলেটা অন্তত নিজের একটা স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছিল। আমার পূর্ণ সমর্থন ছিল এই সিদ্ধান্তের প্রতি।

মেজর (অব.) সিনহার মা নাসিমা আক্তার বলেন, চাকরি থেকে অবসর নেবার পর প্রতি রাতে সে আমার মশারি টাঙ্গিয়ে দিত। আমার সকল ঔষধপত্র নিজে নিজেই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতো, যাতে আমার বুঝতে বিন্দুমাত্র সমস্যা না হয়। যখনই বাড়ির বাহিরে যেত, সবসময়ই নিজের চাবি নিয়ে যেত, যাতে আমাকে বিরক্ত না করতে হয় দরজা খোলার জন্য। তারপর কক্সবাজারে এক মাসের জন্য থেকে একটা তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা জানালো। আমি সম্মতি দিয়েছিলাম। সে বিয়ে করেনি, আর আমিও তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইনি। ২৬ জুলাই ছিল ওর জন্মদিন। অনলাইন সার্ভিসের মাধ্যমে সে যে রিসোর্টে ছিল সেখানে এক বাক্স চকলেট পাঠিয়ে ছিলাম। কোরবানির ঈদের সময় ছেলেটা আমাকে কক্সবাজারে যেয়ে ওর সাথে ঈদ করতে বলছিল, কারণ তথ্যচিত্রের শুটিংয়ে নাকি আরও কয়েকদিন সময়ের দরকার ছিলো। অসুস্থতার কারণে আমার যাওয়া হয়ে উঠেনি। আমার ছেলে একজন শহীদ। একজন বীরের রক্ত এবং মায়ের অশ্রু বৃথা যেতে পারে না। পরম করুণাময় তাকে জান্নাতে আশ্রয় দিবেন।

আমার ভাই জীবনে একটা সিগারেট পর্যন্ত খায়নি : সিনহার বোন
মেজর (অব.) সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস সাংবাদিকদের বলেন, ঈদের দিন সকাল ১১টার দিকে উত্তরা থানা থেকে কয়েকজন পুলিশ আমাদের বাসায় আসেন। তারা এসে আমার ভাই সম্পর্কে নানান প্রশ্ন করেন। তারা ঘরে থাকা ছবিগুলোও দেখেন। তারা কনফার্ম হতে চেয়েছিলেন আমার ভাই আর্মিতে ছিল কি না। তারা ছবিও তুলে নিয়ে যান। পুলিশ সদস্যরা আমার ভাই সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করলেও একটি বারের জন্য বলেনি যে সে আর নেই।

তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মাদকের অভিযোগ আনা হয়েছে; কিন্তু আমার ভাই তো জীবনে একটা সিগারেট পর্যন্ত খায়নি। আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা তো ভাইকে আর বাস্তবে পাব না। আমরা চাই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। যারা জড়িত, তাদের বিচার হোক।

হত্যার দায় সিনহা ও সিফাতের ওপর চাপিয়েছে পুলিশ
মামলার একমাত্র আসামি করা হয়েছে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে। সিফাতের অপরাধ, পরস্পর (সিনহা ও সিফাত) যোগসাজশে সরকারি কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র তাক করা ও মৃত্যু ঘটানো। এর বাইরেও সিনহা ও সাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনেও মামলা করেছে পুলিশ। উদ্ধার দেখানো হয় ৫০ পিস ইয়াবা ও ২৫০ গ্রাম গাঁজা।

জানতে চাইলে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস সাংবাদিকদের বলেন, আমাকে জানানো হয়েছিল এ কথা এজাহারে আছে? তাহলে পড়ে বলতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিনহার সঙ্গে থাকা ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হলেও তদন্তের পর যে দোষী হবে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কমিউনিটি পুলিশের সদস্য নুরুল আমিন (২১) রাত সাড়ে আটটার দিকে ফাঁড়ির ইনচার্জকে মুঠোফোনে জানান, কয়েকজন ডাকাত পাহাড়ে ছোট ছোট টর্চলাইট জ্বালিয়ে এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে। নুরুল আমিন এ কথা নিজামউদ্দিন ও আরও চারজনকে জানান। স্থানীয় মারিশবুনিয়া নতুন মসজিদের মাইক থেকে পাহাড় থেকে ডাকাত নেমে আসছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ডাকাত প্রতিহত করতে এলাকার সবাইকে একত্র হতে বলা হয়। কিছুক্ষণ পর দুই ব্যক্তি নেমে আসেন। সে সময় ঘটনাস্থলে ২০ থেকে ৩০ জন ছিলেন। এজাহারে বলা হয়, পাহাড় থেকে নেমে আসা দুজনকে শনাক্ত করার জন্য তাদের দিকে মো. মাঈন উদ্দীন নামের (১৯) এক ব্যক্তি তার হাতে থাকা টর্চলাইটের আলো ফেললে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা একজন অস্ত্র উঁচিয়ে তাকে (প্রকাশ অযোগ্য) গালি দেন। এলাকার লোকজনকে ধাওয়া করলে তারা অস্ত্রের ভয়ে নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নেন। পরে তারা দুজন সিলভার রঙের প্রাইভেটকারে করে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজারের দিকে রওনা হন। এ খবর নুরুল আমিন নামের এক ব্যক্তি বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জকে জানান। ইনচার্জ জানান টেকনাফ থানার ওসিকে। তার নির্দেশে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে রাত সোয়া নয়টার দিকে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে যানবাহন তল্লাশি শুরু হয়।

নন্দদুলাল রক্ষিত এজাহারে বলেন, মিনিট বিশেক পর তল্লাশিচৌকির সামনে থামার জন্য প্রাইভেটকারকে সংকেত দেন তারা। কিন্তু গাড়িটি সংকেত অমান্য করে তল্লাশিচৌকি অতিক্রম করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে ইনচার্জ লিয়াকত আলী তল্লাশিচৌকিতে থাকা বøক দিয়ে গাড়িটির গতিরোধ করেন এবং হাত উঁচিয়ে গাড়ির ভেতরে থাকা ব্যক্তিকে বের হতে বলেন। ওই সময় গাড়িচালকের আসনে থাকা ব্যক্তি তর্ক শুরু করেন। তিনি নিজেকে সেনাবাহিনীর মেজর বলে পরিচয় দেন। তার পাশে বসা ব্যক্তিটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন।

মামলায় বলা হয়, ফাঁড়ির ইনচার্জ এ সময় গাড়িচালকের আসনে বসা ব্যক্তিকে গাড়ি থেকে নেমে হাত মাথার ওপর উঁচু করে ধরে দাঁড়াতে বলেন এবং বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। কিছুক্ষণ তর্ক করার পর সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয় দেয়া ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে উদ্যত হন। আইসি (ইনচার্জ) স্যার (লিয়াকত আলী) নিজের ও সঙ্গীয় অফিসার ফোর্সদের জানমাল রক্ষার্থে সঙ্গে থাকা পিস্তল দিয়ে চারটি গুলি করেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
Md Shalahuddin ৫ আগস্ট, ২০২০, ১:৩১ এএম says : 0
পেছনের পৃষ্টা উল্টানো হউক।সত্যটা সবাই জানুক।যার আপনজন গেছে সে সঠিক বিচার পাক।সকল অত্যাচারী নিপাত যাক।
Total Reply(0)
Imrul Kayes ৫ আগস্ট, ২০২০, ১:৩৫ এএম says : 0
We 're deeply shocked & mourn. May his soul rest in peace Jannatul firdous.
Total Reply(0)
Maria Sultana ৫ আগস্ট, ২০২০, ১:৩৬ এএম says : 0
মায়ের কাঁধে পুত্র সন্তানের লাশ খুবি দুঃখ জনক ??? অনেক অনেক কষ্টের জিনিস গুলো
Total Reply(0)
তানবীর ৫ আগস্ট, ২০২০, ১:৩৯ এএম says : 0
হে আল্লাহ পাক তুমি আমাদের ভাইয়াকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করে দিও
Total Reply(0)
ফিরোজ খান ৫ আগস্ট, ২০২০, ১:৫৩ এএম says : 0
যদি এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সঠিক বিচার করা হয় তাহলে তার আত্মা শান্তি পাবে
Total Reply(0)
সুমন ৫ আগস্ট, ২০২০, ১:৫৪ এএম says : 0
এবার এমন একটি দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেওয়া হোক যাতে পরবর্তীতে এই ধরনের অপকর্ম করতে অপরাধীর বুক কাঁপে
Total Reply(0)
রবিনা ৫ আগস্ট, ২০২০, ১:৫৫ এএম says : 0
কিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছি না
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন