টেকনাফে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকান্ড ঘিরে দেশব্যাপী তোলপাড় চলছে। ইতোমধ্যে টেকনাফ বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ২০ জন পুলিশকে ক্লোজ করে সেখানে নতুন পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গঠিত হয়েছে ৪ সদস্যের শক্তশালী তদন্ত কমিটি।
গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ বাহারছড়া শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের মেরিন ড্রাইভ চেকপয়েন্ট সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোঃ রাশেদ খানকে ওই তদন্ত কেন্দ্রের আই সি লিয়াকত হোসেন গুলি করে হত্যা করেছে। নির্দেশদাতা হিসেবে ওই ঘটনার সাথে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রমানকে প্রধান করে
গঠিত ৪ সদস্যের শক্তশালী তদন্ত কমিটিতে সেনা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মোঃ জাকির হোসেন ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ শাহজাহান আলী।
জানাগেছে, চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর শনিবার (১ আগষ্ট) বিকালে মেরিন ড্রাইভ রোডের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ি এলাকার ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর একটি তদন্ত দল ইতোমধ্যেই ঘটনা তদন্ত করেছেন। তদন্তের সময় উপস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, স্থানীয় একটি হেফজখানার ইমাম, মুয়াজ্জিন ও দুজন হাফেজ সেনা কর্মকর্তাদের কাছে বলেছেন, শনিবার রাতে প্রাইভেট কার থেকে যে ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেছে সেটা ছিল একটি নির্মম ঘটনা।
তারা জানান, প্রাইভেট কারের ওই আরোহী (মেজর সিনহা) ফাঁড়ির পুলিশ ইন্সপেক্টর লিয়াকতের নির্দেশমতে ওপরে দুই হাত তুলে বলেন, ‘বাবা আপনারা অহেতুক আমাকে নিয়ে উত্তেজিত হবেন না। আপনারা আমাকে নিয়ে একটু খোঁজ নিন।’ ওই প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো বলেন, মেজর সিনহা এমন কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই 'কুত্তার বাচ্চা' বলেই তাঁর (মেজর সিনহা) বুকে গুলি চালাযন পুলিশ ইন্সপেক্টর লিয়াকত হোসেন। তৎক্ষণাৎ তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
স্থানীয় শামলাপুর বাজারের আবদুল হামিদ নামের একজন ফেরিওয়ালা সেনা দলের কর্মকর্তাদের বলেছেন, এটা সাংঘাতিক অন্যায় কাজ হয়েছে। আমাকে যেখানেই নিয়ে যান আমি সত্য কথা বলব। পুলিশ ক্রস ফায়ারের মতো করে একজন জ্যান্ত মানুষকে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, গাড়ি থেকে নামার পর পরই পুলিশ ইন্সপেক্টর গাড়ির আরোহীকে (মেজর সিনহার) বুকে গুলি চালিয়ে দেয়।”
আরো জানাগেছে, ডিবিসি নামের একটি অনলাইন টিভির সাথে সাক্ষাতকারে মেজর সিলহার মা নাসিমা বেগম বলেছে, ৩১ জুলাই রাত ১০ টা সাড়ে ১০ টার দিকে মেজর সিংহাকে হত্যা করা হয়। অথচ তার নিহত হওয়ার খবর সম্পূর্ণ গোপন রেখে ঘটনার পর রাত ১১ টার দিকে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ তাঁর কাছে মেজর সিংহার ব্যাপারে নানা ধরনের তথ্য জানতে চেয়েছেন। এসময় তিনি সিংহার সাথে কথা বলতে চাইলে তার ফোন বন্ধ পান। তখন ওসির কাছে সিংহার কি হয়েছে জানতে চাইলে ওসি নাকি বলছিলেন সে একটু দূরে আছে।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী কয়েক জনের ভাষ্য মতে মেজর সিংহার বুকে ও গলায় পর পর তিন চারটি গুলি চালিয়ে পুলিশের ওই কর্মকর্তা উল্লাস করে ফোনে ওসি প্রদীপকে বলেছিল খতম করে দিয়েছি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে ওই চেকপয়েন্ট মেজর সিনহার গাড়িটি থামিয়ে মেজর সিংহকে গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নেমে আসার নির্দেশ দেয়া হয়। তখন তিনি দুই হাত উপরে তুলে গাড়ি থেকে নেমে আসার সাথে সাথে এসআই লিয়াকত হোসেন কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দিয়ে পরপর তিন চারটি গুলি ছুড়ে তাকে হত্যা করে এবং উল্লাস প্রকাশ করে ওসি প্রদীপ কে খবর দেয়। সাথে সাথে ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সিনহার মুখে ও বুকে লাথি মেরে তার পকেট এবং ব্যাগ চেক করতে বলেন। এসব বিষয় গুলো থেকে প্রতীয়মান হয় ওসি প্রদীপ মেজর সিংহা হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট তিনি এই হত্যাকান্ডের দায় এড়াতে পারেন না।
এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে এখন চলছে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা। পুলিশের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে নিরীহ মানুষ মারা যাওয়ার বিষয়টি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর এই হত্যাকাণ্ডের পর পর পুলিশের ৪ জন ডিআইজিসহ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এখন কক্সবাজারে অবস্থান করছেন।
পুলিশের কোনো কর্মকর্তা এ হত্যাকাণ্ড এবং তদন্ত কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে মুখ খুলছেন না। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওসি প্রদীপ টেকনাফ থানায় অবস্থান করলেও তিনি ফোন রিসিভ করছেন না। তাই এই ঘটনা সম্পর্কে তাঁর কোনো বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল (৪ আগষ্ট) সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছেন। সকালে কমিটির সদস্যরা টেকনাফের শামলাপুর মেরিন ড্রাভের ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন করে টেকনাফের শাপলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র সহ সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলেছেন। দুপুরে কক্সবাজার শহরের হিলডাউন সার্কিট হাউজে আনুষ্ঠানিক এক সভায় মিলিত হন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
দীর্ঘক্ষণ বৈঠকের পর দুপুর সাড়ে তিনটায় অপেক্ষামান মিডিয়া কর্মীদের কাছে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত
বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান।
তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্ত শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে কথা বলে আগামী ৭ দিনের মধ্যে আমরা তদন্ত রিপোর্ট দিতে পারব বলে আশা করছি।
জানাগেছে মাদকের বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জিরো টলারেন্সকে অপব্যবহার করে টেকনাফের ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মেতে উঠেছেন বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্যে। বিএনপির আমলে প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর আশির্বাদে চাকুরীতে যোগ দিয়ে নিজের কুকীর্তি আড়াল করতে তিনি এখন রূপ পাল্টিয়ে হয়েছেন মহা আওয়ামী লীগ। তার এই বিতর্কিত কর্মকান্ডে সংকিত জনগন এবং বিব্রত সরকার।
অভিযোগ রয়েছে ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর ওসি প্রদীপ টেকনাফে যোগদান করেন। এর পর থেকে গত দুই বছরে শুধু টেকনাফে ১৪৪টি কথিত বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা সাজানো হয়েছে। আর এসব বন্দুকযুদ্ধের নামে ওসি প্রদীপ কুমার ২০৪ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে।
টেকনাফের ভোক্তভোগী অনেকে জানিয়েছেন, ইয়াবা ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীর ট্যাগ লাগিয়ে নিরীহ এবং অনেক ধনাঢ্য লোকজনকে থানায় ধরে নিয়ে মোটা অংকে অর্থের জন্য চাপ প্রয়োগ করে থাকেন ওসি প্রদীপ। যারা টাকা দিতে পারে না তাদের ভাগ্যে জুটে ক্রসফায়ারের নামে নির্মম মৃত্যু। অভিযোগ আছে অনেকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়েও খুশী হতে না পেরে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়ে টান্ডা মাতায় খুন করা হয় তাদেরকে।
এদিকে মেজর (অবঃ) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খাঁন হত্যার ঘটনায় কক্সবাজার পুলিশ যেই বিবৃতি দিয়েছে, সেটির সঙ্গে ডিজিএফআইর করা মাঠ প্রতিবেদনটি সাংঘর্ষিক। পুলিশ দাবি করেছে, পুলিশের একটি বহর মেজর (অবঃ) সিনহার গাড়ি তল্লাশি করতে চাইলে তিনি নিজের ব্যক্তিগত অস্ত্র বের করেন। এ সময় আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ গুলি করে। এটি অনেকটা পুলিশের ওই বেপরোয়া খুনকে আড়াল করারই শামিল।
টেকনাফের নির্যাতিত ও ভোক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে মাদক নির্মূলে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্সকে সম্মান জানিয়ে মাদক নির্মূলের নামে ওসি প্রদীপের কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা বন্ধ করার দাবি উঠেছে। #
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন