শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সরকারের জন্য অহেতুক সংকট

| প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০২০, ১২:০৪ এএম

কক্সবাজারের মেরিণড্রাইভ সড়কে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসারপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদের মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। এ ঘটনা জনমনে ব্যাপক উদ্বেগও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ঈদের আগের রাতে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির তল্লাশি চৌকিতে পুলিশ্রে গুলিতে নিহত হন সিনহা। অবসরপ্রাপ্ত একজন সেনা কর্মকর্তার এই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সমাজে নানাবিধ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পুলিশের হাতে তথাকথিত ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যান্ডের পর গুলি চালানোর দায়ে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা বরাবরই আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর যুক্তি খাড়া করে থাকে। মেজর সিনহার মৃত্যুর পরও এর কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, আত্মরক্ষার্থে তাকে গুলি করা হয়েছে। যদিও প্রত্যক্ষদর্শিদের বরাতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে মেরিন ড্রাইভ সড়কে সিনহার সাথে পুৃলিশের তেমন কোনো বাকবিতন্ডা হয়নি। পুলিশের পক্ষ থেকে দায়ের করা একাধিক মামলায় নিহত সিনহা ও তার সঙ্গী সিফাতকে অভিযুক্ত করা হলেও প্রত্যক্ষদর্শিদের বিবরণ ও সিনহার পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা মামলায় এই মৃত্যুর ঘটনাকে স্পষ্টত হত্যাকান্ড বলে দাবি করার হয়েছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, সিনহা ছিলেন ছিলেন কমান্ডো ট্রেনিং পাওয়া অফিসার। তিনি এসএসএফেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পিস্তল থেকে গুলি চালাতে পারদর্শী ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি পুলিশের দিকে পিস্তল তাক করেছিলেন, এমন অভিযোগে তার বুকে ও গলায় তিনটি গুলিবিদ্ধ হলেও কোনো পুলিশ সদস্য আহত হয়নি। সিনহার পিস্তল থেকে গুলি করার কোনো তথ্য প্রাথমিক কোনো তদন্তে এখনো জানা যায়নি।

করোনাভাইরাস মহামারী, দীর্ঘস্থায়ী বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুযোগ ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় সরকার যখন বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন এমন সময়ে পুলিশের গুলিতে তরুণ সাবেক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে যে সব প্রশ্ন উঠে এসেছে তা সুক্ষè, নিরপেক্ষ পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি রাখে। এই ঘটনা একদিকে সরকারকে অহেতুক বিব্রতকর বিতর্কের মধ্যে ঠেলে দেয়া, পুলিশের ভাব-মর্যাদা ও আস্থা পুনরুদ্ধারে বর্তমান পুলিশ প্রধানের চেষ্টা ও সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং দেশের স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতিকে দেশে-বিদেশে আবারো প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস বলে গণ্য হতে পারে। এ ধরনের হত্যাকান্ড কক্সবাজারের অন্যতম আকর্ষণ মেরিন ড্রাইভের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পর্যটন সম্ভাবনাকেও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গত দুই বছরে টেকনাফ-কক্সবাজার মেরিনড্রাইভ সড়কে বন্দুকযুদ্ধের নামে অন্তত ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের বেশকিছু ঘটনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৮৪ কিলোমিটার সড়কটি একটি আতঙ্কের মহাসড়কে পরিনত হয়েছে। দেশের প্রধান পর্যটন নগরীর সাথে এমন আতঙ্ক বিভীষিকার কলঙ্ক লেপন করার মাধ্যমে কক্সবাজারের নিরাপত্তা ও পর্যটন সম্ভাবনাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। অপরাধিচক্রের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধি সদস্যরা এসব অপকর্মে জড়িত।

একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা তার পরিচয় নিশ্চিত করার পরও যখন নিজের জীবনের নিরাপত্তা পাননি, তখন সাধারণ মানুষের অবস্থা কি তা সহজেই অনুমেয়। হঠাৎ করেই ওসি প্রদীপ, লিয়াকত বা নন্দদুলালরা এমন বেপরোয়া হন্তারক হয়ে উঠেননি। এর পেছনে রয়েছে প্রশাসনের দীর্ঘদিনের প্রশ্রয় ও অমনোযোগিতা। অভিযোগ উঠেছে, ওসি প্রদীপ কুমারের নির্দেশে এসআই লিয়াকতের গুলিতে সিনহার মৃত্যুর পর এএসআই নন্দদুলাল বাদি হয়ে নিহত সিনহা এবং তার সহযাত্রী সিফাতের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করেছে তাতে মাদক, অস্ত্র এবং হত্যাকান্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্যদিকে সিনহার বোন ভাই হত্যার অভিযোগ এনে কক্সবাজারের আদালতে ওসি প্রদীপ কুমার, লিয়াকতসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ওসি প্রদীপ কুমারের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভুত হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মত অনেক অভিযোগের কথা শোনা যায়। ইতিপূর্বে উঠে আসা এসব অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হলে সিনহা হত্যার মত ন্যক্কারজনসক ঘটনার সৃষ্টি হতো না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে এমন অনেক বিপথগামী সদস্য রয়েছে, যারা হত্যাকান্ড, অপহরণ,মুক্তিপণ আদায় এবং মাদক সেবন ও মাদক চোরাচালানের সাথে জড়িত। এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা না নিলে জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। একজন ওসি বা তার দোসরদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকান্ডের দায় পুরো বাহিনীর নয়। সিনহা হত্যার পর সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, সিনহা হত্যার দায় ব্যক্তির, কোনো বাহিনীর নয়। পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজির আহমেদ এবং সেনাপ্রধানের যৌথ বিবৃতিতেও সিনহা হত্যার ঘটনায় রাষ্ট্রীয় দুই বাহিনীর মধ্যকার সুসম্পর্কে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। সিনহার মায়ের কাছে ফোন করে প্রধানমন্ত্রী উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা আশা করি ইতিমধ্যে গঠিত বিভিন্ন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সিনহা হত্যার প্রকৃত মোটিফ বেরিয়ে আসবে। এই করোনা ও বন্যা দুযোর্গের সময় সরকার যখন বড় ধরনের মানবিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তখন ঠান্ডা মাথায় একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার পেছনে দেশকে অস্থিতিশীল করা এবং বাহিনীসমূহের মধ্যে অন্তর্দ্ব›দ্ব সৃষ্টি করার কোনো ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা সক্রিয় ছিল কি না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমরা মনে করি, এ হত্যার দায় ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের। এ সব ব্যক্তিকে দ্রæত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন