বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও বরকত

মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী | প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:০২ এএম

হালাল খাবার মহান আল্লাহর ভালোবাসা এবং জান্নাত লাভের রাস্তা। দোয়া কবুলের হাতিয়ার। বয়সে বরকত হয় এবং ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায় এতে। দুনিয়ার সৌভাগ্য এবং আখেরাতে জান্নাত লাভে সহায়ক হয়। কথায় মিষ্টতা আনে। আমল করার আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। হালাল উপার্জনে বংশের মধ্যে বরকত হয়। নিজের পরিশ্রমে উপার্জন মানুষের ভদ্রতার পরিচায়ক।

ইসলামে যেখানেই পরিশ্রম এবং হালাল উপার্জনের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে সেখানেই হারাম সম্পদ এবং অবৈধ আমদানী-রফতানিতে অর্জিত উপার্জনকে মানবের ধ্বংস, নেক কাজ বরবাদ হওয়া এবং এর ধ্বংসাত্মক প্রতিফলগুলোকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই হালাল উপার্জনকে যেমনিভাবে নেক ও পুণ্যের বিষয় বলা হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে অবৈধ এবং হারাম ধনসম্পদকে বিপদ-মুসিবত এবং পাপাচারের মৌলিক কারণ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বুঝা গেল মুমিন বান্দার জীবনধারাতে হালাল উপার্জন মৌলিক গুরুত্বের দাবিদার। কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা এ ব্যাপারে আমাদের ভরপুর নির্দেশনা দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে, তোমরা তা আহার করো এবং কোনোক্রমেই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৬৮)

অবৈধ উপায়ে উপার্জিত সম্পদের ব্যাপারে আল্লাহ পাক বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস করো না এবং মানুষের ধনসম্পত্তির কিংদাংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের কাছে নিয়ে যেয়ো না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮)

হালাল রিজিক উপার্জন করাকে ইসলাম ইবাদত হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ফরজ ইবাদতসমূহের (নামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি) পরে হালাল উপার্জন করাও একটি ফরজ এবং ইবাদতের গুরুত্ব রাখে।’

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কোনো মানুষ এর চেয়ে উত্তম উপার্জন খায়নি যা সে নিজ হাতে উপার্জন করে খায়। নবী দাউদ (আ.)ও নিজ হাতের উপার্জন খেতেন।’ (সহিহ বোখারি)

নবী মূসা (আ.) দেনমোহরের বিনিময়ে তাঁর স্ত্রীর বকরি চড়িয়েছেন বলে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা শুআইবা (আ.)-এর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: ‘আমার একান্ত ইচ্ছা, আমার এই কন্যা দুটির একটিকে বিবাহ দেব তোমার সাথে এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করে দেবে, আর যদি দশ বছর পুরা করে দাও, তবে সেটা হবে তোমার অনুগ্রহ।’ এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, মূসা বললেন, আমার ও আপনার মাঝে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, আট বছর ও দশ বছর এ দুটির যে কোনো একটি সময় আমি পূরণ করব। আর এটা আমার ইচ্ছাধীন।

হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসূল (সা.)-এর সামনে এই আয়াত তিলাওয়াত করলাম- ‘হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে, তোমরা তা আহার করো ...। হজরত সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে মুসতাজাবুদ-দাওয়া (যার দোয়া কবুল হয়) হওয়ার দোয়া করে দেন। নবীজি (সা.) বললেন, হে সা‘দ! হালাল ও পবিত্র খাবার খাবে তাহলে তুমি মুসতাজাবুদ-দাওয়া হয়ে যাবে। ঐ সত্ত্বার কসম যার হাতে মোহাম্মদের প্রাণ! প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি নিজের পেটে হারাম খাবার দিয়ে দিয়েছে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার ইবাদত কবুল হবে না।’

আরেক হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই গোশত (দেহ) জান্নাতে যাবে না, যা হারাম (খাবার) থেকে উৎপন্ন। জাহান্নামই এর উপযোগী।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৬১৪)

আজ প্রায়ই অনেকের মুখে অভিযোগ শোনা যায়- এত দোয়া করছি, তারপরও তো আমাদের অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে না! অথচ একটু চিন্তা-ফিকির করলেই দেখা যাবে, আমাদের সমাজজীবনে হালাল উপার্জনের চিন্তা কতটুকু আছে! বলতে গেলে প্রায় শূণ্যের কোটায় আমাদের হালাল-হারাম বেঁচে চলার মানসিকতা।

সাধারণ অবস্থা এরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নিজের মনের বিভিন্ন চাহিদাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হচ্ছে। অথচ মানুষের চাহিদা কুল-কিনারাহীন সমুদ্র। দুনিয়ায় সব আশা পুরণ হবে এ তো অসম্ভব কথা। অথচ এই হরেক রকম চাহিদা পুরা করার জন্য আমাদের প্রতিযোগিতা চলছে নিয়মিত। একটি পরিবারে স্বামীর চাহিদা এক রকম। স্ত্রীর চাহিদা এক রকম। সন্তানের চাহিদা এক রকম। তখন পরিবার প্রধান সবার চাহিদা মেটানোর জন্য ওঠেপড়ে লেগে পড়েন। চিন্তা করেন না এদের অতিরিক্ত চাহিদা পুরা করার জন্য যে উপার্জন করা হচ্ছে তা হালাল না হারাম! বৈধ না অবৈধ। পবিত্র না অপবিত্র। শরিয়তের সীমারেখার ভেতরে না বাইরে। এটা তো সম্পূর্ণ নবীজির কথার বাস্তবায়ন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের এমন এক কাল অতিক্রম করবে, যাতে মানুষ এ কথার চিন্তা করবে না, যে সম্পদ উপার্জন করা হচ্ছে তা হালাল না হারাম?’ (মিশকাত)

যখন মানুষ হালাল খাবারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। ধৈর্য, অল্পেতুষ্ঠি, যুহদ (দুনিয়া অনাসক্তি), অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া, লোভ-লালসা এবং বিলাসিতা পরিহার এগুলোকে তোয়াক্কা করে না, তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বরকত শেষ হয়ে যায়। যার দরুন বেশিও অল্প মনে হয়। এ ধরনের ব্যক্তির যদি কারুনের ভান্ডারও মিলে যায়, সেটাকেও সে নিতান্ত কম মনে করবে। এটাই কারণ যে, সে যখন এই অবৈধ সম্পদ থেকে আল্লাহর রাস্তায় দান-খয়রাত করে তখন তা কবুল হয় না। তা ছাড়া হারাম ব্যাংক-ব্যালেন্স যতক্ষণ পর্যন্ত তার মালিকানায় থাকে ততক্ষণ তার জন্য দোজখের রাস্তা সুগম হতে থাকে।

অবৈধ উপায়ে উপার্জিত সম্পদ পুরাই ধ্বংস। কোনো কল্যাণ নেই এতে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে বান্দা হারাম সম্পদ অর্জন করে, যদি তাকে সদকা করে দেয় তবে তা কবুল হবে না। আর যদি খরচ করে তাহলে তাতে বরকত নেই। মৃত্যুর পর রেখে গেলে তবে জাহান্নামে যাওয়ার উপকরণ।’ (মুসনাদে আহমদ)

হারাম সম্পদ কম আর বেশি নয়, এর থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা একমাত্র হালাল খাবার দ্বারাই সমাজজীবন ঠিক থাকে। দোয়া কবুল হয়। সবকিছুতে বরকত হয়। আল্লাহপাক আমাদেরকে হারাম থেকে বাঁচার এবং হালালের কদর করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Firdousi ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১:১২ পিএম says : 0
টিউশন পড়িয়ে টাকা উপার্জন করা জায়েয আছে কি?
Total Reply(0)
Talha ১৫ নভেম্বর, ২০২১, ৮:৫১ এএম says : 0
আল্লাহ আমাদেরকে বোঝার তৌফিক দান করুন। আমিন
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন