স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-মসজিদ নদীগর্ভে মন্ত্রণালয়ে নেই সঠিক তালিকা
দেশে ২০ বছরের সারাদেশের ৩৫টি জেলার ৮ হাজার স্কুল-কলেজ-মসজিদ এবং মাদরাসা তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। সবচেয়ে এবার বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে রংপুর বিভাগে। এর সংখ্যা ৭৬২টি। এরপর সিলেট বিভাগে ৬৩৫টি, বরিশাল বিভাগে ৩০২টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৪৪৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে গত ২০ বছরের দেশের ৩৫টি জেলার ৮ হাজার স্কুল-কলেজ-মাদরাসা এবং মসজিদ, তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্ম, মেঘনা নদীর ভাঙনে বিলীন হয়েছে বলে স্থানীয় জেলা প্রশাসক অফিসগুলো থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম আল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোর তালিকা তৈরির কাজ চলছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর এসব ভবনকে দ্রæত কীভাবে মেরামত ও ব্যবহারের উপযোগী করা যায়, সেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নদীগর্ভে বিলীন হওয় যাওয়া অনেক জেলা-উপজেলায় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ শেষ। এখন অপেক্ষা নতুন ভবনে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের। কিন্তু বন্যার কারণে সেই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার সুযোগ আর পেলেন না শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সেই সব জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থান নির্ধারণ এখনো ঠিক হয়নি বলে জানা গেছে। অন্যদিকে নদীগর্ভে বিলীন হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঠিক তালিকা নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে বলে জানা গেছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে স্কুল-কলেজ-মাদরাসা খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সে লক্ষ্যে এরই মধ্যে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার। তবে অনেক চরাঞ্চলে মসজিদ না থাকার কারণে অনেক মানুষ নামাজ পড়ে পারছেন না। করোনা বন্ধের পর শিক্ষা স্কুল-কলেজ-মাদরাসা খুলে দেওয়া হলেও লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়া করতে পারবে না।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম আল হোসেন বলেন, নদীতীর ও চর এলাকাতেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। তা না হলে সেখানকার শিক্ষার্থীরা কোথায় পড়বে। নদীর চার কিলোমিটার দূরে ভবন নির্মাণ করার পরও রক্ষা পেল না। তবে ভবিষ্যতে এসব এলাকায় আর প্রথাগত উপায়ে ভবন নির্মাণ করা হবে না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘ এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলো যৌথভাবে দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, চলতি বন্যায় এ পর্যন্ত এক হাজার ৯০২টি বিদ্যালয় ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮১ লাখ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। আর বই, খাতা, কলম, পেনসিলসহ শিক্ষা উপকরণ ভেসে গেছে ১০ লাখ শিক্ষার্থীর।
চরাঞ্চলের বাতিঘর নামে পরিচিত মাদারীপুরের শিবচরের বন্দরখোলা এলাকার এসইএস ডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের তিনতলা ভবনটি পদ্মায় বিলীন হয়েছে এক সপ্তাহও হয়নি। ২০০৯ সালে বিদ্যালয়ে যখন পাঠদান শুরু হয়, তখন পদ্মা নদীর সীমানা ছিল প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। ২০১২ সালে বিদ্যালয় ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এই বিদ্যালয়ে ২৪টি গ্রামের প্রায় ৩০০ ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করত। এই শিক্ষার্থীদের এখন কী হবে, জানতে চাইলে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. আফজাল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, নদী থেকে চার কিলোমিটার দূরে নতুন একটি জায়গা ঠিক করা হয়েছে। সেখানে স্থানীয় একজন দানবীর জমি দিতে চেয়েছেন। ওই জমিতে বিদ্যালয় ভবন করে দিতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে। এত বড় স্কুলের জন্য কে এত বড় জমি দেবে?
শিবচরের চরাঞ্চলে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত নুরুদ্দিন মাদবরকান্দি এসইএস ডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজারের বেশি। পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিদ্যালয়টির ভবন সকাল থেকেই হেলে পড়ে। একপর্যায়ে বিকেলে এটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এছাড়া ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে বন্দরখোলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন, একাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে সবার আগে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ করা হয় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কয়েক দফা বাড়িয়ে সেই ছুটি আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে এই সময়ের পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে না বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এর আগে গত বছরও বন্দরখোলা এলাকার তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পদ্মায় বিলীন হয়েছিল।
এরই মধ্যে যমুনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবনটি। ভাঙনে চরম হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে এরেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের জিগাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি বাজার, নুরানী হাফিজিয়া মাদরাসা, ঈদগা মাঠ, একটি বিএস কোয়াটার, এরেন্ডাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, দু’টি জামে মসজিদ, ৩টি মোবাইল টাওয়ার ও একটি বাজার এখন মারাত্মকভাবে ভাঙনকবলিত।
কুড়িগ্রাম জেলার থেতরাই ইউনিয়নের জুয়ান সাতরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিস্তা নদীতে বিলীন হয়েছে। সঙ্গে মসজিদটিও বিলীন হয়। এখন বিদ্যালয়টি কোথায় স্থাপন করা হবে তার ঠিক করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন। চাঁদপুর সদর উপজেলার চরাঞ্চলে মেঘনা নদীতীরে রাজরাজেশ্বর ওমর আলী উচ্চ বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টারটি নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ শেষ। সেই সুযোগ আর পেলেন না শিক্ষকরা। উদ্বোধনের আগেই নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে নবনির্মিত বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টার ভবনটি।
রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হযরত আলী বেপারী জানান, কয়েকদিন ধরে মেঘনা নদীর পানি বৃদ্ধি ও তীব্র স্রোতের কারণে নবনির্মিত বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেন্টারটি হুমকিতে রয়েছে। যে কোনো সময় নদীতে বিলীন হতে পারে নবনির্মিত ভবনটি।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন ইনকিলাবকে বলেন, শিবচরের প্রতিষ্ঠিত নুরুদ্দিন মাদবরকান্দি এসইএস ডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়টি। বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজারের বেশি। পদ্মার নদীতে বিলীন, এছাড়া ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে বন্দরখোলা ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন, একাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন