শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনাকালে কীভাবে সন্তান প্রতিপালন করতে হবে

ড. শাহিদা তাহের | প্রকাশের সময় : ১০ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

বিশ্বব্যাপী প্রায় সব দেশই এখন করোনা সংক্রমিত হয়েছে এবং কয়েক কোটি লোক আজ করোনার ভয়াল থাবায় আক্রান্ত। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় আজ বেশির ভাগ মানুষ ঘরে বন্দি। যাকে আমরা নাম দিয়েছি লকডাউন। বিশ্ববাসী কখনো এই ধরনের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করতে পারেনি। করোনালকডাউনে স্বাভাবিক মানুষের জীবন নিত্যদিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।


করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মানুষকে নানাভাবে চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কোয়ারেন্টিনে থাকাকালে ভয় এবং দুশ্চিন্তাসহ নানা ধরনের সমস্যা বয়স্ক মানুষ থেকে শুরু করে কমবয়সী ছেলে-মেয়ে এবং শিশুদের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা কেউই এইভাবে কোয়ারেন্টিনে থাকতে অভ্যস্ত নই। তাই সব বয়সের মানুষেরই বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং দিচ্ছেও। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানসিক চাপ, দুর্যোগ ও অশান্তির মধ্যে সবাই এক রকম আচরণ করে না। এরকম একটা পরিস্থিতিতে কে কেমন আচরণ করবে এটা নির্ভর করে তার বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করার দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও মানসিকতা কেমন তার উপর। তাই, এ সময় বাবা- মাকে তাদের সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ যতœবান হওয়া উচিত। সে কারণে, সন্তানদের একাকী না রেখে যতটা সম্ভব তাদের সঙ্গ দেয়া উচিত। যেমন একসঙ্গে খাবার খাওয়া, টিভি দেখা, গল্প করা এবং একসাথে ঘরের অন্যান্য কাজ করা ইত্যাদি

গৃহবন্দি থাকাকালে বড় দায়িত্ব মা-বাবাকেই অথবা সংসারের উপার্জনক্ষম ও স্থিতিশীল মানুষদেরই বহন করতে হচ্ছে। কারণ বাবা-মা নিজেদেরসহ বাসায় থাকা বয়স্ক মানুষ, শয্যাশায়ী, শিশু-কিশোর ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সবাইকে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে রাখার দায়িত্ব স্বভাবতই তাদের ওপর এসে পড়ে। মনোচিকিৎকদের মতে, শিশুরা বেশিদিন ঘরে আটকে থাকার ফলে ঘ্যান-ঘ্যান করতে পারে, বেশি কান্নাকাটি, জেদ প্রকাশ ও বিরক্ত করতে পারে। কারো কারো বেশি ভয় থেকে পুরনো অভ্যাসও দেখা দিতে পারে। যেমন: ছোট শিশুরা আবার বিছানায় প্র¯্রাব করা শুরু করতে পারে। এগুলো অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।

শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. লিসা ড্যামুরের উক্তি দিয়ে ইউনিসেফ বলেছে যে, এই অস্থির সময়টাতেও শিশুদের একটা রুটিনের মধ্যে থাকতে হবে। তারা কখন কাজ করবে, কখন পড়বে? সেই রুটিন তৈরির সময় উনি মনে করেন, ছেলেমেয়েদের সম্পৃক্ত করা উচিৎ। তাদেরও বুঝতে দেওয়া উচিৎ, কেন তারা এইসব নিয়ম কানুনের মধ্যে থাকবে। তবেই তারা বুঝবে, এইভাবেই আমাদের প্রতিবেশী ও চারপাশের মানুষের যত্ন নিতে হবে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পরিবারের শিশু-কিশোরদের ঘুম ও খাওয়ার অভ্যাসে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না, তা বাবা-মাকে লক্ষ রাখতে হবে। এ সময় শিশুদের ঘুম ও পড়াশোনার ক্ষেত্রে মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ বন্ধ, টিউশনি বন্ধ। ফলে স্কুল, কলেজ, পরীক্ষা না থাকায় পড়াশোনায় ঢিলেমিভাব চলে আসাটাই স্বাভাবিক। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই, বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গৃহবন্দি হবার ফলে ঘরে বসে বসে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। সুযোগ পেলেই বাইরে যেতে চাইছে। যেতে মানা করলে রাগ হচ্ছে। রাতে দেরিতে ঘুমাচ্ছে, সকালে দেরি করে উঠছে। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে সময় কাটাচ্ছে, পড়াশোনা করতে চাইছে না। এ নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মার গোলযোগ বাঁধছে। সেক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের পড়ার টেবিলে আটকে রাখা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হয় বাবা-মায়ের জন্য। কিন্তু এরপরও চাপ না দিয়ে ভালভাবে বুঝিয়ে অল্প অল্প করে পড়ার কাজটা গুছিয়ে নিতে হবে।

বাবা-মা তাদের সন্তানদের সহ দিনের একটি সময় বেছে নিবেন ব্যায়াম ও মেডিটেশন করার জন্য। এতে শরীরে প্রফুল্লভাব আসবে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যায়াম ও মেডিটেশনের কোনো বিকল্প নাই। সে সাথে প্রয়োজন মতো পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করতে হবে।

সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে নয়। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখতে হবে। সবসময় করোনা সংক্রান্ত মহামারির খবর দেখা, পড়া ও শোনা থেকে বিরত থেকে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নানা ধরনের খেলাধুলা করতে হবে, গল্পের বই পড়ে শোনাতে হবে। হাতের কাছে যা থাকবে, তাই দিয়ে শিশুদের খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখতে হবে। মোবাইলেও নানা ধরনের গেম আছে। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয় এবং সময় ভালোভাবে কেটে যায়। ফলে বাবা-মাকে তারা অহেতুক বিরক্ত করবে না।

বাবা-মা এ সময় তাদের ছোট ছোট সন্তানদের নানা ধরনের জীবনমুখী ও সামাজিক দক্ষতা শেখাতে পারেন। যেমন পড়া-লেখা শিখানো, নিজে নিজে গোসল করা, নিজের হাতে খাবার খাওয়া, বড়দের সম্মান করা, প্রার্থনা করা এবং টয়লেট ট্রেনিংয়ের শিক্ষা দেয়া ইত্যাদি। এছাড়া ছোটখাটো দু-একটা বাড়ির কাজে ছেলেমেয়েদের লাগালে তারা কাজটি শিখতে উৎসাহিত বোধ করে, অন্যদিকে সময়ও পার করা যায়।

সুন্দর সময় কাটানোর উত্তম উপায় হলো বাগান করা। যাদের বাড়িতে সামান্য জায়গা আছে, হতে পারে সেটা বারান্দা অথবা ছাদ, তারা সেখানে ছোটখাটো বাগান করতে পারেন। হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন বীজ ও গাছ দিয়ে বাগানের কাজ শুরু করা যেতে পারে। বাগানের কাজে শিশুদেরও সাথে নিতে হবে যাতে তারা মাটি, বীজ এবং গাছপালা সমন্ধে জানতে পারে এবং চিনতে পারে। ফলে ছোটবেলা থেকেই গাছপালার ব্যাপারে শিশুদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হবে। তাছাড়া, বাবা-মা সন্তানদের নিয়ে পরিবারের তোলা বিভিন্ন স্মৃতিময় ছবি বের করে দেখতে পারেন এবং তা গুছিয়ে রাখতে পারেন। এতেও সময় ভালোভাবে কেটে যায়।

বাবা-মা এ সময় সন্তানদের ডায়েরি লেখা, গল্প-কবিতা লেখা, ছবি আঁকার অভ্যাস তৈরি করার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে পারেন। শিশুর ভেতর লুকিয়ে থাকা অপার সম্ভাবনাগুলো খুঁজে বের করা এবং সেগুলোর বিকাশে সহযোগিতা প্রদানে মা-বাবার সচেতনতা ও সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই।

টিনএজ বা বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েরা সাধারণত অভিভাবক বা বাবা-মায়েদের কাছে সবসময় থাকতে পছন্দ করে না, তারা বন্ধুদের সঙ্গ বেশি পছন্দ করে। অনেক সময় বাবা-মার সাধারণ কথাতেও তারা বিরক্ত হয়। আবার তাদের আশেপাশে বাবা-মাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারে। এরকম অবস্থায় সন্তানের প্রতি বাবা-মাকে অনেকটাই সহযোগিতামূলক আচরণের মাধ্যমে শান্তভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। নতুবা তারা বিরূপ আচরণ প্রকাশ করতে পারে বা আরো রাগান্বিত হতে পারে।

করোনার প্রভাব সম্পর্কে শিশুদের সঙ্গে সময় নিয়ে কথা বলতে হবে। সব তথ্য শেয়ার করতে হবে এবং যেভাবে বললে তারা বুঝবে সেভাবেই বলতে হবে। পরিবারের বাবা-মায়ের দায়িত্ব হচ্ছে একদিকে যেমন শিশুদের চিন্তামুক্ত রাখা, অন্যদিকে শিশুদের এই নতুন ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করা। শিশু যেন এই অন্যরকম পরিস্থিতিতে ভয় না পায় এবং কোনোভাবেই তাদের মনে আতঙ্ক ছড়ানো যাবে না। কী কী নিয়ম মেনে চলতে হবে, তা প্রথমে নিজেদের জানতে হবে এবং তা মানা হচ্ছে কি না সেটাও কঠিনভাবে নজরে রাখতে হচ্ছে। তবে, নিয়মের তোড়ে শিশুদের যেন হাঁসফাঁস অবস্থা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুরা যে নিরাপদ, সেটাও তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। পরিবারে সকলের মাঝে একটি আনন্দময় পরিবেশ বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।

করোনার এই বিশেষ অবস্থায় গৃহবন্দিকালে বাবা-মায়েরা পরিবারের সকলকে ভালো রাখার জন্য কঠিন দায়িত্ব পালন করছেন। তারপরেও বাবা-মাকে যতটা সম্ভব ঠান্ডা মেজাজে, শান্ত ও ধীরস্থিরভাবে এই নেতিবাচক পরিস্থিতি সাহসের সাথে মোকাবেলা করতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গার্হস্থ্য অর্থনীতি (শিশুর বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
kamrul islam ১১ আগস্ট, ২০২০, ১২:৩৩ পিএম says : 0
EXCILLENT WRITING.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন