বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পানি কমছে বাড়ছে বন্যার্তদের দুর্ভোগ

খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০২০, ১২:০২ এএম

দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। আশ্রয় শিবির বা উঁচু বাঁধে আশ্রয় নেয়া অনেকে বাড়ি-ঘরে ফিরছেন। তবে বন্যাকবলিত মানুষের জীবনে এখন নতুন দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। ঘরের ভিতর থেকে পানি নেমে গেলেও ভিটেমাটি এখনো কাদা-পানিতে একাকার। বেড়া ভাঙা, মাথার ওপর চাল ফুটো। টিউবওয়েল নষ্ট, খাবার ও ওষুধ কিছুই নেই তাদের। আয়-রোজগার বন্ধ। অনেকের বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সব হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। আশ্রয় নেয়ার মতো কোনো ঠাঁই নেই। সরকারি ত্রাণ সহায়তা কিছুই পাচ্ছে না। বন্যাকবলিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন রোগবালাই। আমাশয়, ডায়রিয়ার মতো পানিবাহিত রোগের সঙ্গে রয়েছে চর্মরোগ। বিদ্যুতের খুঁটির গোড়ার মাটি সরে যাওয়ায় সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। এ কারণে একরকম অন্ধকারে আছেন বানভাসিরা। সব মিলিয়ে বন্যার্তরা এখন চরম কষ্টে পড়েছেন।
বন্যা প‚র্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি কমছে। এটি আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। পদ্মা নদীর পানিও কমছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। উত্তর-প‚র্বাঞ্চলের উজানে মেঘনা অববাহিকায় প্রধান নদীর পানি কমছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। রাজধানীর আশপাশের নদীগুলোর পানি স্থিতিশীল রয়েছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। ঢাকার চারপাশের নদীর পানি স্থিতিশীল থাকতে পারে। ফলে জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আগামী চারদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এদিকে গতকাল মন্ত্রীসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ভাদ্র মাসে বন্যার বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন।
কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেব জানান, বন্যাপরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন রোগব্যাধি। মানুষের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে গবাদি পশুও। বানভাসি মানুষ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতে রোগব্যাধি নিয়ে রয়েছে চরম দুশ্চিন্তায়। এমনিতে হাতে টাকা পয়সা না থাকায় ঘরবাড়ি মেরামত করা, ভেঙে পড়া নলকুপ ও লেট্রিন সংস্কার নিয়ে রয়েছে বিপাকে। এই অবস্থায় সরকারিভাবে সহযোগিতাও প্রায় বন্ধ। মানুষ এখন খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্র জানায়, চলতি বন্যায় ৩ হাজার ৮৯২টি গরু লাম্পি স্কিন ডিজিজসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়াও বন্যার পূর্বে ২৬ হাজার ৩শ’ গরুকে টিকা প্রদান করা হয় বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু মাঠের চিত্র ভিন্ন। এখনো সাড়ে ৪ শতাধিক চরে অসংখ্য গরু লাম্পি স্কিনসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত আছে বলে জনপ্রতিনিধিসহ ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
চাঁদপুর থেকে বি এম হান্নান জানান, বানের পানির কমতে শুরু করলেও দুর্ভোগ বেড়েছে। মাত্র দুদিনের জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে শত শত পুকুরে চাষ করা মাছ। পানিতে নিমজ্জিত ৪ শতাধিক পানের বরজ, ফসলি জমিসহ নদীপাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকা। চাঁদপুর জেলার হাইমচরে ৬টি ইউনিয়নে পানি ঢুকে পড়ে। এতে তলিয়ে যায়, বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাছের ঘের, পানের বরজ। মূলত দক্ষিণের সাগর ফুঁসে ওঠায় এবং উজানের পানির চাপে চাঁদপুরে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভেঙে যায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দুটি অংশ। নদী তীরবর্তী এলাকা থেকে পানি কমতে শুরু করলে চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দুটি অংশ ভেঙে যাওয়ায় হাইমচরের মানুষ এখনো পানিবন্দি। স্বাভাবিক জীবনে তারা এখনো ফিরতে পারেনি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার বিষয় নিয়ে তারা শঙ্কিত।
সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, যমুনা নদীর পানি কমলেও দুর্ভোগ বেড়েছে বন্যা দুর্গত মানুষের। পানি কমার সাথে সাথে নানাবিধ রোগ-বালাই শুরু হয়েছে। খাবার স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের অভাব দেখা দিয়েছে। খাদ্যাভাব, জ্বালানি সঙ্কট, অপ্রতুল ত্রাণ তৎপরতার কারণে বন্যার্তদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। বন্যার পানি কমে যাওয়ায় জেগে উঠেছে ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতচিহ্ন। কাদামাখা ঘরবাড়ি, উঠানে চলাফেরা করা, রাতে বিদ্যুতের অভাবে অন্ধকারে চলাফেরা করা, কিংবা কুপি, বাতি, মোম, হারিকেনের আলোও প্রচন্ড বাতাসে নিভে যাওয়া সবকিছু মিলে বন্যার্তদের মধ্যে চরম দুরবস্থা বিরাজ করছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে।
টাঙ্গাইল থেকে আতাউর রহমান আজাদ জানান, সবকটি নদীর পানি কমতে থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। বন্যার থাবার শিকার হয়েছে ১১টি উপজেলার ৬ লাখ মানুষ। টাঙ্গাইল সদর, নাগরপুর, কালিহাতী, ভূঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলায় নদীভাঙনে ২ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ঘারবাড়ি হারা এসব মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রশাসনের মাধ্যমে যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছে।
গাইবান্ধা থেকে আবেদুর রহমান স্বপন জানান, ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার নিচে নেমে আসার ফলে জেলার সবগুলো নদ-নদীর পানি এখন বিপদসীমার নিচে। ঘাঘট, তিস্তা, করতোয়া ও বাঙালীসহ অন্যান্য নদীর পানি বিপদসীমার অনেক নিচে নেমে আসে। কিন্তু নদী তীরবর্তী ২৬টি ইউনিয়ন ও চরাঞ্চল থেকে এখনো বন্যার পানি নেমে যায়নি। ঘরবাড়ির উঠান এখনো বন্যার পানিতে নিমিজ্জিত। দীর্ঘ ৪৫ দিন যাবৎ বন্যার পানিতে তলীয়ে আছে এসব ঘরবাড়ি। ফলে এসব পরিবারগুলো এখনো বাঁেধ ও আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে। একারণে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের জনদুর্ভোগ বেড়েছে। ভাষার পাড়া গ্রামের রহমান জানান ঈদের আগে ত্রাণ ও ভিজিএফ এর চাল পেয়েছি। কিন্তু এ চাল দিয়ে ৭ দিনও চলেনি। ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে না যাওয়ায় এখনো বাঁধেই রয়েছে। কোনো কাজ নেই পরিবারের ৫ জনকে নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে রয়েছি।
জামালপুর থেকে নুরুল আলম সিদ্দিকী জানান, বন্যার পানি না থাকলেও রয়ে গেছে বানভাসিদের দুর্ভোগ। দীর্ঘ এক মাসের বন্যায় লন্ডভন্ড করে দিয়েছে তাদের বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট। চারিদিকে কাদা ও রাস্তা-ঘাট লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ায় ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের। দীর্ঘ একমাসের বন্যায় জেলার ৭ উপজেলায় পানি তোড়ে কাঁচা-পাকা রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় যাতায়াতে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকার লাখো মানুষ। বন্যাকবলিত এলাকায় অধিক সময় ধরে কোনো কাজ না থাকায় হাতে টাকা নেই, এতেকরে তারা খাবার যোগাড় করতে পারছে না। খাবার না থাকায় এক বেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের।
লালমনিরহাট থেকে মো.আইয়ুব আলী বসুনীয়া জানান, লালমনিরহাটে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি কমে যাওয়ায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও নদী তীরর্বতী এলাকার বানভাসি মানুষগুলোর দুর্ভোগ চরমে। এবারে তিস্তা নদীর পানি দফায় দফায় বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তিস্তা ও ধরলায় ৫ দফা বন্যা হয়েছে। বন্যায় এলাকার বানভাসি মানুষগুলো দীর্ঘ প্রায় ১ মাস পানিবন্দি থাকার পর এখন বন্যার পানি নেমে গেলেও বানভাসি মানুষগুলোর দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। তাদের ঘরে এখনো কাদা। বেড়া ভাঙা। ঘরে খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। সব মিলিয়ে দুভোর্গ এখন চরমে।
সিলেটের বালাগঞ্জ থেকে আবুল কালাম আজাদ জানান, বালাগঞ্জ বাজারের একমাত্র সড়কের পুরাতন থানার সম্মুখ হাল্কা বৃষ্টি হলেই হাঁটুসমান নর্দমার পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। নর্দমার পানিতে র্দুগদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় পথচারী ও ব্যবসায়িরা পড়েছেন বিপাকে। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষের কোনো নজরদারি দেখা যাচ্ছে না!
লক্ষীপুর রামগতি থেকে আমানত উল্লাহ জানান, মেঘনার ভাঙন প্রতিরোধে বাঁশ, গাছ ও গাছের ঢালপালা দিয়ে ‘জংলা বাঁধ’ নির্মাণ করছেন লক্ষীপুরের রামগতি-কমলনগর উপজেলা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাকর্মীরা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন