বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ব্যবসা বাণিজ্য

আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড লেনদেনে অস্পষ্টতা

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০২০, ৭:৪১ পিএম | আপডেট : ১১:১৮ পিএম, ১৬ আগস্ট, ২০২০

  • এককালীন ৩শ’ ডলারের অধিক কেনাকাটায় ‘সতর্ক’ থাকার নির্দেশনায় বিপাকে গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তারা
  • পণ্য বা সেবা ক্রয়ের সুযোগ বন্ধ করা হয়নি : বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র


বিদেশ থেকে পণ্য ও সেবার বৈধ কেনাকাটার বিপরীতে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড (আইসিসি) ব্যবহারে জুরি নেই। আধুনিক বিশ্বে ক্রেডিট কার্ডকে বলা হয় প্লাস্টিক মানি। এক কথায় এটি একটি কার্ড যা ব্যাংক বা এ ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে একজন গ্রাহক নিতে পারে। এর বৈশিষ্ট্য হাতে নগদ টাকা না থাকলেও এই কার্ড দিয়ে কেনাকাটা করা যায়। নির্দিষ্ট সময় পর তার ওই টাকা পরিশোধ করা যায়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকরা দীর্ঘদিন থেকে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে নানা প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী ক্রয় করছেন। এর মাধ্যমে দ্রুত লেনদেন করা যায়, নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি থেকে মুক্তি এবং অধিকতর নিরাপদ হওয়ায় প্রতিদিনই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ক্রেডিট কার্ড।

এই সুবিধাকে গ্রাহকরা সাধুবাদ জানালেও ক্রেডিট কার্ডের আন্তর্জাতিক লেনদেনে সম্প্রতি এক নির্দেশনা নিয়ে গ্রাহক ও ব্যাংকারদের মধ্যে এক ধরণের ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মধ্যে বিপরীতমুখী অবস্থানের উদ্ভব হয়েছে। নির্দেশনায় অনলাইন কেনাকাটায় এক লেনদেনে ৩শ’ ডলারের অতিরিক্ত খরচ রোধে ‘সতর্ক’ থাকতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই অস্পষ্ট নির্দেশনায় বিপাকে পড়েছে ব্যাংকার ও গ্রাহক। ‘সতর্ক’ থাকতে বলা হয়েছে কিন্তু এক্ষেত্রে কি করণীয় এ রকম কোন উত্তরই গ্রাহকদের দিতে পারছে না ব্যাংকাররা। আর তাই এক ধরণের সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।

অপরদিকে অসঙ্গতিপূর্ণ ও অস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েই দায় শেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। যদিও শুধু দেশি গ্রাহকরা বিপদে পড়ছে তা নয়। বাংলাদেশে যেসব বিদেশি অবস্থান করছেন তারাও পড়ছেন নানা বিড়ম্বনায়। কারণ হোটেল বুকিংসহ একটু দামি পণ্য ক্রয় করতে গেলেও বারবার অনুমতি নিতে হয় ব্যাংকের। আর এক্ষেত্রে পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। অথচ সরকার উদার বিনিয়োগ নীতিকে উৎসাহিত করছে।

প্রায় পাঁচ বছর ধরে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন একটি বিদেশি এয়ারলাইন্সের ঢাকা অফিসের কর্মকর্তা মোহসেনা। অনলাইনে কিংবা দোকানে গিয়ে কেনাকাটা উভয়ক্ষেত্রেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন তিনি। এর বাইরে বিমান টিকেট এবং বিদেশ সফরে হোটেল বুকিংয়ের ক্ষেত্রেও তার ভরসা ক্রেডিট কার্ড। নগদ অর্থ বহনের ঝামেলা নেই আর পর্যাপ্ত টাকা হাতে না থাকলেও পরে দেয়ার সুবিধার কারণেই তিনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এককালীন ৩শ’ ডলারের বেশি লেনদেন নিয়ে কড়াকড়িতে প্রায়শই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাকে।

মোহসেনা বলেন, একটি দামি ব্রান্ডের ঘড়ি বা হোটেল বুকিং কি কোনভাবে ৩শ’ ডলারের মধ্যে সম্ভব। তাই অনেক সময় বাধ্য হয়েই প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের চিন্তাও বাদ দিতে হয় জানালেন মোহসেনা। তবে এটা শুধু মোহসেনার ক্ষেত্রেই নয়; তার মত অনেক গ্রাহকই প্রতিদিন এভাবে বিপাকে পড়ছেন। সুযোগ থাকা স্বত্তে¡ও ক্রয় করতে পারছেন না প্রয়োজনীয় পণ্যটি।

এছাড়াও একাধিক গ্রাহক বলেছেন, বিদেশ থেকে পণ্য ক্রয়ের অনুমতি চেয়ে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর ভিসা পাওয়াও অনেকটা সহজ। ব্যাংকাররা বলছেন, নির্দেশনায় কোন কিছুই স্পষ্ট করা হয়নি। নির্দেশনায় অসঙ্গতি থাকায় গ্রাহকরা প্রয়োজন হলেও ৩শ’ ডলারের বেশি একাকালীন লেনদেন করতে পারছেন না। ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে অনুমোদন দিলেও পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জেরা ও হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। আর তাই উপায় না পেয়ে ব্যাংকাররা গ্রাহকদের সাহায্য করছেন না। কারণ তাহলেই হয়তো তাকে বিপাকে পড়তে হবে। একাধিক ব্যাংকার বলেন, তাদের হাত বাঁধা। নির্দেশনার বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ নেই। তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা বিড়ম্বনার স্বীকার হতে হয় তাদের।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, সতর্ক থাকতে বলা মানে ৩শ’ ডলারের বেশি ব্যবহার করা যাবে না, তা নয়। অবশ্যই হোটেল বুকিং বা পণ্য ক্রয়ে এর থেকে বেশি ডলারের প্রয়োজন হয়। গ্রাহক অবশ্যই তার স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে পারবে। তবে যাতে কোনভাবে এই সুযোগের অপব্যবহার বা অর্থ পাচার না হয় সে জন্য ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

সূত্র মতে, আন্তর্জাতিক পণ্য কেনাকাটায় কার্ড ব্যবহারকারী গ্রাহকদের লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করে ২০১৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনে কার্ড ব্যবহারকারী গ্রাহকের এককভাবে কোনো পণ্য বা সেবামূল্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩শ’ ডলার পর্যন্ত পরিশোধের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বছরে তা কোনো অবস্থাতেই এক হাজার ডলারের বেশি হবে না। কিন্তু সম্প্রতি সকল ব্যাংকের কাছে জারিকৃত এক নির্দেশনায় অনলাইন কেনাকাটায় এক লেনদেনে ৩শ’ ডলারের অতিরিক্ত খরচ রোধে সতর্ক থাকতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এ নির্দেশে বিপাকে পড়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকরা।

তবে কড়াকড়ি আরোপের মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলা, বৈদেশিক লেনদেন, বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনাবেচা, ক্রিপ্ট কারেন্সি ও লটারির টিকিট কেনার কাজে এ কার্ড ব্যবহার করার সুযোগ না থাকাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন গ্রাহকরা। তবে প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী ক্রয়ে এককালীন অনলাইন লেনদেনে সর্বোচ্চ ৩শ’ ডলার নির্ধারণ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন গ্রাহকরা। তাদের মতে, এই সীমা তুলে দেয়া উচিত। কারণ হোটেল বুকিংসহ অনেক প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ৩শ’ ডলারের অধিক। যা সুযোগ দিয়েও হাত-পা বেধে দেয়ার মতো। তাই এ ধরণের নীতিমালা থাকা উচিত নয় বলে মনে করছেন গ্রাহকসহ সেবা প্রদানকারী ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অনলাইনে পণ্য বা সেবা ক্রয়, হোটেল বুকিং, বিদেশে শিক্ষা গ্রহণে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ এবং বিদেশে প্রশিক্ষণ/সেমিনার/ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ ফি দেয়া যাবে। তবে তা এককালীন ৩শ’ ডলারের বেশি হলে নিতে হবে ব্যাংকর অনুমতি। এক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গ্রাহকদের অনলাইন ট্রানজেকশন অথরাইজেশন ফরম বা ওটিএএফ পূরণ করে ব্যাংকগুলোতে জমা দিতে হবে। এরপর ব্যাংক সেটি যাচাই-বাছাই করে কোনো অসংগতি না পেলে গ্রাহকরা ক্রেডিট কার্ডের ওই ডলার ব্যবহারের অনুমতি পাবেন। তবে এসব জটিলতা ও ব্যাংকে নানা বিড়ম্বনায় প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা ক্রয়ের আগ্রহই হারিয়ে ফেলছেন গ্রাহক। আর এতে গ্রাহক-ব্যাংকার সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে প্রতিদিনই।

এককালীন ৩শ’ ডলারের বেশি দামে পণ্য বা সেবা ক্রয়ে সতর্কতার নামে গ্রাহক হয়রানির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, অনলাইন কেনাকাটার নামে যাতে কোনভাবে অর্থ পাচার না হয় সে দিকটা নজর রাখবে ব্যাংক। তার মানে এই না পণ্য ক্রয় ও সেবা ৩শ’ ডলারের বেশি করা যাবে না। কারণ এখন অনেক প্রয়োজনীয় পণ্যের দামই ৩শ’ ডলারের বেশি। তিনি বলেন, দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে এ নির্দেশনায় পরিবর্তন আনা হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, সতর্কতা ‘পজিটিভ’ শব্দ। এর অর্থ এই নয় যে, গ্রাহকরা ৩শ’ ডলারের বেশি অনলাইনে এককালীন পণ্য বা সেবা ক্রয়ে করতে পারবে না। তাই নির্দেশনাকে ভুল বলা যাবে না। কারণ ৩শ’ ডলারের বেশি সেবা নিতে নিষেধ করা হয়নি বা সীমাবদ্ধ করা হয়নি। মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, হোটেল বুকিং বা পণ্য ক্রয়ে অনেক ক্ষেত্রেই এককালীন ৩শ’ ডলারের অধিক প্রয়োজন হয়। সেটা অবশ্যই গ্রাহক স্বাভাবিকভাবে করতে পারবেন। তবে যাতে কোনভাবে মিসইউজড বা অন্য উদ্দেশে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে। তিনি বলেন, ১০০ টাকা পাচার হওয়াও দেশের জন্য ক্ষতি। তাই যাতে অর্থ পাচার না হয় সে জন্য সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
Masud Alam Bablu ১৬ আগস্ট, ২০২০, ৮:৪০ পিএম says : 0
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি। এরকম দায় সা্রা নির্দেশনা দিলে আরও ভ্রান্তি তৈরি হবে।
Total Reply(0)
তাসফিয়া আসিফা ১৬ আগস্ট, ২০২০, ৮:৪১ পিএম says : 1
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বহীন নির্দেশনায় আমরা ক্ষুব্ধ।
Total Reply(0)
হিমেল ১৬ আগস্ট, ২০২০, ৮:৪২ পিএম says : 0
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয়টি স্পষ্ট করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা উচিত। নাহলে সাধারণ গ্রাহকরা ভোগান্তির শিকার হবে।
Total Reply(0)
মোহাম্মদ মোশাররফ ১৬ আগস্ট, ২০২০, ৮:৪৩ পিএম says : 0
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা কতটা দায়িত্বহীন তা এই রিপোর্ট পড়লে বোঝা যায়।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন