রাজধানী ঢাকাশহর রক্ষা বেড়িবাঁধের এক হাজার ৪১ দশমিক ১৫৮২ একর জমি খেয়ে ফেলেছে (দখল) ভ‚মিদস্যুরা। প্রভাবশালী ব্যক্তি দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করায় বাঁধ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে জমি উদ্ধার করা যায়নি। এবার ঢাকা মহানগর জরিপে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধীন জমি উদ্ধারে নতুন কৌশল নিয়েছে সরকার। ভূমিদস্যুদের হাত থেকে জমি দখলমুক্ত করতে ভুল রেকর্ড সংশোধন করা হবে। এ জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়সহ ভূমি জরিপ অধিদফতরকে চিঠি দিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার ইনকিলাবকে বলেন, অবৈধ দখলে থাকা ঢাকা মহানগর জরিপে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধিন এক হাজার ৪১ দশমিক ১৫৮২ একর জমি ভুল রেকর্ড বোনাফাইড মিসটেক হিসেবে সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা রেকর্ড সংশোধনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়সহ ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছি। পাউবোর জমি উদ্ধারে তৎপরতা চলছে। সংশ্লিষ্ট ঢাকা জেলাসহ সংশ্লিষ্ট ডিসিদের কাছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অবৈধ স্থাপনা উদ্ধারে সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড জমি উদ্ধারে দায়িত্ব পালন করবে।
তবে ঢাকা জেলা বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আমি নতুন এসেছি। আমার আগে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা কি করেছে জানি না। আমি সরকারের কাজ করতে এসেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধীন সরকারি জমি উদ্ধারে ভুল রেকর্ড সংশোধনের বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বন্যা হয়। তখন যমুনার পানি বিপদসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অবশ্য এবার সেটি ১২ সেন্টিমিটার উঠে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। তাতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৯৫ শতাংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। তখন ঢাকা মহানগরীকে বন্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নব্বই দশকের শুরুতে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর পাদদেশ বাদামতলী-বাবুবাজার, সোয়ারীঘাট, রায়ের বাজার, বসিলা, মোহাম্মদপুর তিন রাস্তা, গাবতলী হয়ে টঙ্গীর আবদুল্লাহপুর ব্রিজ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করে। ঢাকা শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণের পর একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বাঁধের উভয় পাশে অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তোলেন ব্যক্তিগত দোকান, বাসা-বাড়ি, স্কুল-কলেজ, গরুর খামার, হাউজিং কোম্পানি, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বড় বড় শিল্প কারখানা।
ঢাকা শহরের সমন্বিত বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের দৈর্ঘ ৩৫ কিলোমিটার। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর বন্যা থেকে রক্ষার রাজধানীর উত্তরা আব্দুল্লাহপুর থেকে পুরাতন ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজ পর্যন্ত নির্মিত এই বেড়িবাঁধের ৩২ কিলোমিটারের দু’পাশ ঢাকার শহর রক্ষা বেড়িবাঁধের বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধিন ১ হাজার ৪১ দশমিক ১৫৮২ একর জমি ভুল রেকর্ড করে দখলে নিয়েছে প্রভাবশালীরা। প্রায় ১৫শ’ প্রভাবশালী ব্যক্তি অবৈধভাবে বেড়িবাঁধ দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করায় বাঁধ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মালিকানাধীন ওই জমি উদ্ধারে কয়েকদফা চেষ্টা করা হয়।
গত ১৬ জুলাই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে ঢাকা মহানগর জরিপে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধিন ১ হাজার ৪১ দশমিক ১৫৮২ একর জমি ভুল রেকর্ড বোনাফাইড মিসটেক হিসেবে সংশোধনের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় কার্যপত্রে বলা হয়, ঢাকা শহর সম্বলিত বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ প্রকল্পের জন্য ঢাকা জেলার আব্দুল্লাহপুর থেকে মিটফোর্ড হাসপাতাল পর্যন্ত থানাধীন বিভিন্ন মৌজায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩০ দশমিক ২০০ কিলোমিটার বাঁধ এবং সুইস গেট এবং পন্ডিং এরিয়া নির্মাণ করা হয়। একইসঙ্গে আবদুল্লাহপুর থেকে ছোটদিয়া পর্যন্ত ১৮ দশমিক ৫০০ কিলোমিটার বাপাউবোর একক মালিকানা হওয়া ঢাকা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে গেজেট প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত গেজেটে আবার ৫৩৫ দশমিক ৫০ একর বাঁধের জমি ৬ দশমিক ৯৫ একর সুইস গেইটে এবং ৬৩০ দশমিক ৯৭ একর পন্ডিং এরিয়ার জমি। সব মিলে ১ হাজার ১৭৩ দশমিক ৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। পরবতীতে ঢাকা মহানগর জরিপসম্পন্ন হওয়ার পর ডিজিটাল ঢাকাবেজ তৈরি করার সময় দেখা যায়, জমি অধিগ্রহণকৃত ১ হাজার ১৭৩ দশমিক ৪২ একর জমির মধ্যে সিটি জরিপে ১৩২ দশমিক ২৬ একর জমি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নামে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ৪২৬ দশমিক ৪৬৩৩ একর জমি এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির নামে ৬১৪ দশমিক ৬৯৪৯ একর জমি রেকর্ড করা হয়েছে। এসব জমি সকল কাগজপত্র বোনাফাইড মিসটেক হিসেবে ভুল রেকর্ড সংশোধনের জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসককে বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার চিঠি দেয়া হলে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু পাউবো কোনো সহযোগিতা পায়নি। ফলে উদ্ধারও হয়নি বেদখলে থাকা জমি। অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে প্রতিবছর উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে তা বাস্তবায়ন হয় না। শুধু ঢাকাতেই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাউবোর পাঁচ হাজার একর জমি বেদখল হয়ে আছে। এসব জমি বেড়িবাঁধ, ছোট ছোট নদী ও জলাশয়ের অংশ। রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রভাবশালী দখলদাররা এসব জমিতে আবাসন প্রকল্প, বিপণিবিতান, স্কুল-কলেজ, ডেইরি ফার্ম, গাড়ির গ্যারেজ, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে দখল করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন