বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

পাকিস্তান চীনের ভাই ও অংশীদার : শি জিনপিং

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২২ আগস্ট, ২০২০, ৮:১০ পিএম | আপডেট : ১২:১৬ এএম, ২৩ আগস্ট, ২০২০

পাকিস্তানকে চীনের ভালো রকমের ভাই ও অংশীদার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। গত শুক্রবার পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভিকে পাঠানো এক বার্তায় এই মন্তব্য করেন তিনি। বেইজিংয়ের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপেক) রাজনৈতিক পক্ষগুলোর দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের সমাপনী দিনে ওই বার্তা পাঠান তিনি। এর আগে চীনা প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।
পাকিস্তানকে স্বাধীনভাবে তার জাতীয় অবস্থার ভিত্তিতে উন্নয়নের পথ বেছে নেয়ার জন্য, আরও ভাল বাহ্যিক সুরক্ষার পরিবেশের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়ে আরও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার জন্য পাকিস্তানকে সর্বোতভাবে মদদ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে চীন। গেল শুক্রবার বেইজিংয়ে চীনের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশীর মধ্যে আলোচনার পর জারি করা একটি যৌথ বিবৃতির অংশ হিসাবে খবর সামনে আসে। উভয় পক্ষ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর-সিপিসি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুর পাশাপাশি করোনা মহামারী, বিশেষত এর অর্থনৈতিক পরিণতি কীভাবে মোকাবেলা করতে পারে সেগুলি সহ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পর্যালোচনা করে।
চীনের শি জিনপিং এ বৈঠককে আরো একধাপ গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ‘পাকিস্তান চীনের ভালো ভাই ও অংশীদার যারা বিশেষ বন্ধুত্ব ভাগ করে নিয়েছে।’ তবে যৌথ বিবৃতিটির উল্লেখযোগ্য অংশটি ছিল পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের জন্য উপযুক্তভাবে নীতি বিকশিত করার পক্ষে চীনের একনিষ্ঠ সমর্থন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘চীন পক্ষ পুনরায় উল্লেখ করেছে যে, পাকিস্তান ও চীন লৌহবন্ধনের ভাই এবং পাকিস্তান এ অঞ্চলে চীনের অবিসংবাদিত অংশীদার। সে কারণে চীন পাকিস্তানকে তার আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার সুরক্ষায় ও তার জাতীয় অবস্থার উপর ভিত্তি করে স্বাধীনভাবে একটি উন্নয়ন পথ বেছে নেয়ার পক্ষে সংগ্রাম করে উন্নততর বাহ্যিক সুরক্ষা পরিবেশ এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিষয়গুলিতে আরও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই বিবৃতিটি কিছু দেশে একটি বার্তা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে হতে পারে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, আরব বিশ্বের নির্দিষ্ট পাকিস্তানি বন্ধুরা ইসলামাবাদকে চীনের থেকে দূরে সরে আমেরিকা ও তার সহযোগীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের দিকে চাপ দিচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, পাকিস্তান চীনকে একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অংশীদার মনে করে। যৌথ বিবৃতিতে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তান বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরআই’র বিষয়ে সমঝোতা করতে প্রস্তুত নয় এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের চাপ সত্ত্বেও দেশটি সিপিইসি’র অগ্রণী কর্মসূচি অব্যাহত রাখবে। দু’ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও কাশ্মীর সহ আঞ্চলিক সুরক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন যে, একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, পারস্পরিক সহযোহিতা পূর্ণ এবং সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া সব দলের স্বার্থেই প্রয়োজন। পাকিস্তান তার পক্ষ থেকে জাতীয় সুরক্ষা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পাকিস্তানের সাথে একত্র হয়ে দাঁড়ানোর জন্য চীনকে প্রশংসা করেছে এবং তাইওয়ান, শিনজিয়াং, তিব্বত ও হংকংয়ের মতো চীনের মূল স্বার্থ ও বড় উদ্বেগের বিষয়গুলিতে বেইজিংয়ের প্রতি তার জোরালো সমর্থনকে প্রদান করেছে। উভয় পক্ষ আফগান ইস্যুতে সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছে এবং আন্তঃআফগান আলোচনার সূচনা করার জন্য আফগান সরকার এবং তালেবানদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছে। তারা আফগানিস্তানে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বিস্তৃত এবং ব্যাপক আলোচিত চুক্তির গুরুত্বকে জোর দিয়েছে।
চীনের সাথে বৈঠকের আগে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি কাশ্মীর নিয়ে সউদী আরবের সমালোচনা করার ফলে সউদী সফরে গিয়ে অপমানিত হন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া। আর তারপরই চীন সফর করেন কুরেশি। কিছুদিন আগে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনের-ওআইসি’র মঞ্চে কাশ্মীর ইস্যু তোলার কথা জানায় পাকিস্তান। ওআইসি ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেয় দেশটি। তাতেই ক্ষুব্ধ হয় সউদী আরব। তেল তো দূরের কথা, পাকিস্তানকে ঋণও দেওয়া হবে না বলে জানায় দেশটি। এদিকে, পাকিস্তানের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে, সউদী আরবের থেকে নেওয়া ঋণের দায় নামাতে শেষে চীনের থেকে টাকা নিয়ে ঋণ শোধ করে পাকিস্তান। আর সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে সউদী আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের সখ্যতার কারণে ইসলামাবাদ থেকে দ‚রত্ব বাড়াচ্ছে রিয়াদ। কারণ, ওআইসির প্রধানের পদ থেকে সউদী আরবকে সরিয়ে ইসলামিক দেশগুলির এই সংগঠনের নেতৃত্বে বসতে চেষ্টা চালাচ্ছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইপ এর্দোগান। কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের অবস্থানকে প্রকাশ্যে সমর্থনও জানিয়েছে তুরস্ক।
গত বছরের ফেব্রæয়ারিতে সউদী যুবরাজের পাকিস্তান সফরের সময়ে ৬২০ কোটি ডলারের ঋণ ও তেল সরবরাহের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তবে ওআইসি’র পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বিশেষ বৈঠক ডাকতে ইসলামাবাদ রিয়াদের ওপর চাপ প্রয়োগ করলে ওই চুক্তি বাতিলের কথা জানায় সউদী আরব। মূলত সউদী আরবের নেতৃত্বাধীন ওআইসি কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের বিরুদ্ধে না দাঁড়ানোয় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শাহ মহম্মদ কুরেশি সউদীকে সতর্ক করে দেন। এমনকি ওআইসি ভেঙে দেওয়ারও হুমকি দেন তিনি। তার পরেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয় সউদী আরব। কাশ্মীর বিষয়ে ওআইসির নীরবতার বড় কারণ ভারতের সঙ্গে সউদী আরব ও আরব আমিরাতের সুসম্পর্ক। ওআইসি বর্তমানে সউদবংশই অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের সমর্থক হিসেবে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর সহ অনান্য মুসলিম দেশ। ভারতের সঙ্গে এসব দেশের নিবিড় সম্পর্ক কাশ্মীর বিষয়ে ওআইসিকে নমনীয় রেখেছে। এরমধ্যে, আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরায়েলের সুসম্পর্ক স্থাপনের ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, আপাতত ভারত, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দিচ্ছে রিয়াদ ও আবুধাবি। এভাবেই রিয়াদ-আবুধাবি-নয়াদিল্লি-তেল আবিব-ওয়াশিংটন মৈত্রী জোটের সমীকরণ। ইসরায়েলের পূর্ণ কূটনীতিক সম্পর্কের ঘোষণার পর আরব আমিরাতকে প্রথম অভিনন্দন জানানো দেশগুলোর একটি ছিল ভারত।
এ পরিস্থিতিতে ওআইসির বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রপন্থী নেতৃত্বকে রুখতে ও মুসলিম বিশ্বে আধিপত্য অর্জন করতে পাল্টা সমীকরণ হাতে নেয় চীন। সেই সমীকরণের ফলে ইরান ও পাকিস্তানের সঙ্গে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠছে চীনের। ইতিমধ্যে চীন-তেহরান ৪০০ বিলিয়ন ডলার অঙ্কের বড়সড় এক চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করে ফেলেছে। এই খসড়ার প্রথম ধাক্কাতেই ভারতের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে শুরু করেছে। পাশাপাশি, ইরান-চীন মৈত্রীকে মোকাবিলা করতে গিয়ে ভারতের রিয়াদকে কাছে টানতে দেখে পাকিস্তানের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তুরস্কও। এভাবেই ‘রিয়াদ-আবুধাবি-নয়াদিল্লি-তেল আবিব-ওয়াশিংটন’ জোটের জবাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে ‘বেইজিং-ইসলামাবাদ-আঙ্কারা-তেহরান-দোহা’ জোট। তবে পরিস্থিতি একদম একতরফা ভারসাম্যহীন নয়। পাকিস্তানের ওপর রিয়াদের কিছু সামরিক নির্ভরতা রয়েছে। সউদীর উদ্যোগে গঠিত ৩৯ জাতির সন্ত্রাসবিরোধী ইসলামি সামরিক জোটের এক বড় শক্তি পাকিস্তান। জোটের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন পাকিস্তানের জেনারেল রাহিল শরিফ। এ পরিস্থিতিতে রিয়াদ পাকিস্তানকে যত দূরে ঠেলে দেবে, অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই পাকিস্তান ইরানের সঙ্গে ততোটাই সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে। তেহরান-ইসলামাবাদ মৈত্রী রিয়াদের জন্য ভবিষ্যৎ এক নিরাপত্তাঝুঁকিও। পরিস্থিতি বিবেচনায় তেহরান-ইসলামাবাদ-আফগানিস্তান সুসম্পর্ককে মদদ দেয়ার জন্য চীনকে সার্বিকভাবে প্রস্তত বলেই মনে হচ্ছে। সূত্র: দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, সিনহুয়া।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
fatema akhter ২৩ আগস্ট, ২০২০, ৯:৩৫ পিএম says : 0
thanks that remember that.It was
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন