বর্ষা বিদায়ের লগ্নে ভাদ্রের বড় অমাবশ্যায় ভর করে সৃষ্ট লঘু চাপের প্রভাবে ফুসে ওঠা বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের সাথে উজানের ঢল আর অবিরাম বর্ষনে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল সয়লাব হবার পরে এখন নদ-নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে একাধীক জনপদ। সারা দেশ থেকে বয়ে আনা পানি এ অঞ্চলের বড় নদ-নদীগুলো সাগরে পতিত হবার মুখে গ্রাস করছে মানুষের ভিটেমাটিসহ সরকারী বেসরকারী স্থাপনা। সর্বশান্ত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার। নদ-নদীবহুল দক্ষিনাঞ্চলের কোটি মানুষের বেশীরভাগের জীবনের সাথেই নদী জড়িত। এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনের ভাঙা গড়ার খেলা চলছে নদীর সাথে। নদী তাদের অনেককিছু দিলেও আবার করছে সর্বশান্ত। এখনো নদী ভাঙনে ‘সকাল বেলার আমীর ফকির সন্ধা বেলা’।
কিন্তু এর পরেও নদী ভাঙন রোধে দ্রত কোন প্রকল্প গ্রহন থেকে বাস্তবায়ন হচ্ছে না দক্ষিণঞ্চলে। এমনকি সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে নদী ভাঙন রোধে আজ পর্যন্ত কোন সমন্বিত নিবিড় কর্মসূচীও গ্রহন করা হয়নি। যেসব প্রকল্প অনেক কাঠখড় পড়িয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন লাভ করে তার বাস্তবায়নও হয় বিলম্বিত। এমনকি আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মানে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন এখনো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সব ধরনের জটিলতা এড়াতে পরিকল্পনা গ্রহণ, পরিবীক্ষণ এবং বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগণ সহ জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করারও দাবী উঠেছে। বরিশালে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ‘কোষ্ট’ আয়োজিত “জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল উপকূলীয় বাঁধ নির্মান ও টেকসই নিরাপত্তায় প্রয়োজন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংস্কার” শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা নদী ভাঙ্গণ প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তাতে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না বলে জানান। বরং পাউবোর প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।
অপরদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জনবল সংকট এবং পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে বাঁধ নির্মান ও নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারার দাবী করা হয়েছে ঐ সেমিনারে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ৪৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ চাহিদার বিপরিতে পাওয়া যায় মাত্র ৪১ কোটি টাকা। ফলে বাঁধ সংস্কার সহ নদী ভাঙ্গণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় না বলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের তরফ থেকে দাবী করা হয়েছে।
দক্ষিনাঞ্চলের বিভিন্নস্থানে নদ-নদীর ভাঙন রোধ সহ নদী শাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ইতোপূর্বে ৩১টি প্রকল্প পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় এবং পরিকল্পনা কমিশনে পেশ করা হলেও তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ঘুরপাক খাচ্ছে।
বেশ কিছু নদী শাষন ও ভাঙন রোধ প্রকল্প যাচাই-বাছাই কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী এখনো পুণঃগঠন পর্যায়ে রয়েছে। কিছু প্রকল্প-প্রস্তাবনা ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাষ্ট’ এ তহবিলের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। আবার কিছু প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন সহ অধিকতর যাচাই-বাছাই পর্যায়ে রয়েছে। বেশ কয়েকটি প্রকল্প কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির বিবেচনাধীন বলেও জানা গেছে। আবার কিছু প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের প্রি-একনেক’এর বিবেচনায়। কয়েকটি প্রকল্প-প্রস্তাবনা বিবেচনা না করেই ফেরত দেয়া হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে। আবার অর্থের অভাবে অনুমোদিত অনেক প্রকল্পের অগ্রগতিই খুব একটা আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে নেই। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে পাঁচ সহ¯্রাধিক কোটি টাকা।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে বরিশাল জেলার ৮টি স্থানে নদীভাঙন রোধে প্রায় ৮৮৭ কোটি টাকা, পটুয়াখালীর ৩টি নদী ভাঙন রোধ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৬শ’ কোটি টাকা, ভোলায় মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর ভাঙন থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জনপদ রক্ষায় ৮টি প্রকল্পের জন্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা, ঝালকাঠীর সুগন্ধা ও কালিজিরা নদীর ভাঙন থেকে নৌ বাহিনীর আঞ্চলিক বেজ স্টেশন সহ ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২শ’ কোটি টাকা এবং বরগুনার ৩টি প্রকল্প বাস্তায়নে ৪২৭ কোটি টাকার প্রকল্প-প্রস্তাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সহ পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। এছাড়াও পিরোজপুর জেলার দুটি প্রকল্পের জন্যও প্রায় ৫৪ কোটি টাকা প্রয়াজন। তবে জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার এ দুটি প্রকল্প জিওবির তহবিল সহ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাষ্ট থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এদিকে সুগন্ধা নদীর ভাঙন থেকে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কের দোয়ারিকাতে ‘বীর শ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু’ ও এর সংযোগ সড়ক রক্ষায় প্রায় ৮ বছর আগে ১১ কোটি টাকার প্রকল্পÑপ্রস্তাব অনুমোদন না হওয়ায় এখন প্রয়োজন হবে প্রায় ২৩৫ কোটি টাকা। এসংক্রান্ত প্রকল্পÑপ্রস্তাবনাটি আরো প্রায় ১০মাস আগে একনেক-এর চুড়ান্ত অনুমোদন লাভ করলেও এখনো তা দরপত্র পর্যায়ে।
২০১৭-এর নভেম্বরে বরিশাল মহানগরী সংলগ্ন চরবাড়ীয়া এলাকার কির্তনখোলা নদীর ভাঙন রোধে ৩৩১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেক-এর অনুমোদন লাভ করলেও তার বাস্তবায়নও বিলম্বিত হচ্ছে একর পর এক প্রকৃতিক দূর্যোগের সাথে অর্থ সংকটে। সরকারী নির্দেশনার আলোকে প্রকল্পটি বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর নিয়নস্ত্রনাধীন খুলনা শিপইয়ার্ড বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতির সাথে অর্থ ছাড় না করায় প্রকল্পের কাজ কাঙ্খিত মাত্রায় এগুচ্ছে না। গত অর্থবছরে প্রকল্পটির জন্য ৫০ কোটি টাকা চাহিদার বিপরিতে পাওয়া গেছে ৫ কোটি টাকারও কম।
মেঘনা, তেঁতুলিয়া, বলেশ্বর, সুগন্ধা, সন্ধ্যা, বিষখালী ও পায়রা সহ বড় নদ-নদী গুলো উজানের পানি সাগরে বয়ে নিয়ে যাবার পথে ভাঙছে দক্ষিণাঞ্চলের একের পর এক জনপদ ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি স্থাপনাসমুহ। কিন্তু তা প্রতিরোধ কার্যক্রমে এখনো যথেষ্ঠ ধীর গতি। অতি সাম্প্রতিক প্লাবন আর উজানের ঢলের পানিতে সয়লাব দক্ষিণাঞ্চলের পানি সাগরে বয়েনিয়েযাবার পথে নদ-নদীগুলোর ভাাঙন ক্রমশ তীব্রতর হয়েছে। বরিশালে মেঘনা পাড়ের মেহেদিগঞ্জের একাধীকশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সরকারীÑবেসরকারী স্থাপনাও নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে। একই অবস্থা বাবুগঞ্জের মীরগঞ্জ ও বিমানবন্দরের উত্তর প্রান্তের সুগন্ধ নদী তীরের মানুষের। সুগন্ধার বুকে বিলীন হয়েছে বীর শ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর উজানে একটি স্কুল ভবন সহ মসজিদও। কুয়াকাটা সাগর সৈকত ক্রমশ সংকুচিত হয়ে উক’লীয় বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধে আঘাত হানলেও গত দশ বছর ধরে শুধু নানা ধরেনর গবেষনা আর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অতিসম্প্রতি পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামিম সরেজমিনে কুয়াকাটা পরিদর্শন করে ভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছেন। ভোলায় ভাঙন রোধে একাধীক প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তব কার্যক্রম শুরু হলেও অর্থের অভাবে গতি ক্রমশ ধীর হচ্ছে। গোটা দক্ষিণাঞ্চল যুড়ে এখন কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে নদী ভাঙনে সর্বশান্ত মানুষের আহাজারী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন