বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সর্বাগ্রে ভূমি রক্ষা করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

দু’মাসেরও বেশি সময় পর এই প্রথম দেশের নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাঁচ দশকের মধ্যে এবারের বন্যায়, যা দ্বিতীয় দীর্ঘতম, অধিকাংশ নদী বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে নদীভাঙন তীব্র ও ব্যাপক হয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা প্রভৃতি বড় নদীর সঙ্গে ছোট নদীগুলোর মধ্যেও তীব্র ভাঙনপ্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এতে বহু জমিজমা, বাড়িঘর, ক্ষেতের ফসল ও বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এই ভাঙনের রেশ থাকতে থাকতেই নতুন করে প্রায় সব নদীর ভাঙন দেখা দিয়েছে। এত দিন নদীর পানি বাড়ার কারণে ভেঙেছে, আর এখন পানি কমার কারণে ভাঙছে। বরাবরই নদ-নদীর পানি কমার সময় এ ধরনের ভাঙন দেখা দেয়। এবার ভাঙনের তীব্রতা অন্যান্য বারের তুলনায় বেশি। এভাবে প্রতি বছর নদীভাঙনে কত জমি, কত বাড়িঘর, কত মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল ও অন্যান্য স্থাপনা যে বিলীন হয়ে যায়, তার কোনো হিসাব নেই। নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে যায় অসংখ্য পরিবার। তারা সব কিছু হারিয়ে পথের ফকিরে পরিণত হয়। এও লক্ষ করা গেছে, নদীভাঙনের ফলে মূল ভূখন্ড সংকুচিত হয়ে পড়ছে, মানচিত্রে পরিবর্তন ঘটছে। সীমান্তনদীগুলোর সবই ভাঙনপ্রবণ এবং সে ভাঙন বাংলাদেশমুখী। নদীর ভাঙন ভারতীয় অংশে বাঁধ নির্মাণ করে ভাঙন বন্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ অংশে ভাঙন রোধে কোনো বাঁধ নেই। ফলে নদী ভেঙে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ ভূমি হারাচ্ছে। আর ওপারে যে চর জাগছে, তা দখল করে নিচ্ছে ভারত। তার জমি বাড়ছে।

দেশের অভ্যন্তরে নদীভাঙনে উপকূলীয় ভূভাগ, দ্বীপ ও চরাঞ্চল নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। হাতিয়া, স›দ্বীপ, ভোলা প্রভৃতি এলাকার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে জানানো হয়েছে, হাতিয়ার মূল ভূখন্ড ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে। সত্তরের দশকে এর আয়তন ছিল ৫৫৫ বর্গকিলোমিটার। মেঘনার উপর্যুপরি ভাঙনে তা কমে বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটারে। ইতোমধ্যে মূল ভূখন্ডের চার পাশে শতাধিক চর জেগে উঠেছে বটে, তবে অনেক চরই ভাঙনের মুখে পড়েছে। সুবর্ণচর ও ভাসান চরের মতো বড় বড় চরও জেগে উঠেছে। সব চরের সুরক্ষা ব্যবস্থা সমভাবে নেয়া হয়নি। হাতিয়ার মূল ভূখন্ডের অংশে নলচিরা, চরকিং, চরঈশ্বর, সোনাদিয়া ইত্যাদির বিশাল এলাকা যেমন বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তেমনি নতুন জেগে ওঠা চর হরনী ও চান্দনীর অংশবিশেষও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে ভাঙন ও ভূমিলোপের ঘটনা স›দ্বীপ, ভোলা প্রভৃতি দ্বীপাঞ্চলে মোটেই নতুন ও বিরল নয়। আশঙ্কা করা হয়, হাতিয়া, সন্দীপ ও ভোলার বহু এলাকাই নদী ও সাগরগর্ভে হারিয়ে যাবে যদি সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না হয়। দুঃজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ভাঙনের হাত থেকে মূল ভূখন্ড রক্ষার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা, তা নেয়া হয়নি। বেড়িবাঁধই ভাঙন রোধের প্রধান উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, অথচ উঁচু ও টেকসই বাঁধ নেই বললেই চলে। অধিকাংশ বাঁধ নিচু ও ভঙ্গুর। তাও বছরের পর বছর মেরামত করা হয় না। ফলে সামান্য পানির তোড়েই বাঁধ ভেঙে ভেসে যায়। লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে এবং ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে যায়। বাঁধ নির্র্মাণ, মেরামত, সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়, অথচ তা খুব একটা কাজে লাগে না। কখনো কখনো তাৎক্ষণিক কিছু উপকার হলেও স্থায়ীভাবে পানির অনুপ্রবেশ ও ভাঙন রোধে তা কোনো ভূমিকা রাখে না। কার্যত বরাদ্দকৃত অর্থের বেশির ভাগই অপচয় ও লুটপাট হয়ে যায়।

সীমান্তেই হোক, আর দেশের অভ্যন্তরেই হোক সর্বাগ্রে মূল ভূখন্ড রক্ষা করতে হবে। যে কোনো মূল্যে তা করতে হবে। এক ইঞ্চি ভূখন্ডও হারানো যাবে না। এরপর নদী ও সাগরগর্ভ থেকে যেসব ভূখন্ড জেগে উঠেছে এবং মূল ভূখন্ডের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে কিংবা চর বা দ্বীপ হিসেবে আলাদা অস্তিত্বে টিকে থাকছে সেসব ভূখন্ড, চর ও দ্বীপ রক্ষা করতে হবে। যাতে কোনোভাবেই বিলীন হয়ে না যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নদীভাঙন রোধে সাফল্য দেখিয়েছে। সাগর মুখে বাঁধ দিয়ে ভূমি বাড়িয়েছে অনেক দেশ। সাগরের মধ্যে কৃত্রিম দ্বীপ পর্যন্ত নির্মাণ করেছে কোনো কোনো দেশ। চীন, ব্রিটেন, জার্মানি নদী শাসনে এবং হল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, আমিরাত সাগর শাসনে কৃতিত্ব দেখিয়েছে। আমাদের নদী ও সাগর শাসনে আমরা তাদের কাছ থেকে সহায়তা নিতে পারি। ভাঙন রোধে উঁচু ও শক্ত বাঁধ কার্যকর বলে প্রমাণিত। বন ও বৃক্ষরাজি ভাঙন ঠেকাতে পারঙ্গম। সুন্দরবন যেভাবে জলোচ্ছ্বাস ঠেকিয়ে দেয়, সেটাই এর প্রমাণ। নদীতীর ও সাগর উপক‚লে বাঁধের পাশাপাশি বনবেষ্টনী তৈরি করতে পারলে ভাঙন সহজেই ঠেকানো সম্ভব। এই সঙ্গে নদীতীর ও উপক‚ল রাস্তাও নির্মাণ করা যেতে পারে, মসৃণ যাতায়াত ও ভাঙন ঠেকাতে তা ভ‚মিকা রাখতে পারে। আমরা বরাবরই লক্ষ করে থাকি, বিভিন্ন সুরক্ষা বাঁধ বা বেড়িবাঁধ নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কারে বর্ষাকালকেই প্রধানত বেছে নেয়া হয়। এ সময়ের কাজে ফাঁকিবাজি করা যায় বলেই সম্ভবত এটা করা হয়। সরকারিভাবে বরাবরই শুকনো মওসুমে এ জাতীয় কাজ করার জন্য তাকিদ দেয়া হয়। কিন্তু ব্যত্যয় ঘটলে জবাবদিহি করা হয় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, এবারের দীর্ঘ বন্যায় বাঁধের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখনই বাঁধ মেরামত ও সংস্কারে হাত দিতে হবে। পুরো শুকনো মওসুমটা কাজে লাগাতে পারলে বাঁধ মেরামত ও সংস্কারের কাজ ভালোভাবে সমাধা করা সম্ভব হবে। সরকার ভূখন্ড সুরক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে, এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন