শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করতে হবে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের গণহত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, বিতাড়ন ও বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়ার তিন বছর পূর্তি হয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ হলেও মিয়ানমার থোড়াই কেয়ার করে চলেছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমারকে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দিলেও, সে তোয়াক্কা করেনি। ফলে তাদের এই বক্তব্য-বিবৃতি অনেকটা লিপ সার্ভিসে পরিণত হয়েছে। অথচ প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে মহাবিপদের মধ্যে আছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চুক্তিসহ বিভিন্ন সময়ে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করলেও মিয়ানমার ডেমকেয়ার করে চলছে। একজন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে না নিয়ে শক্ত বস্থানে তারা। আন্তর্জাতিক আদালতে হেরে যাওয়া বা ভর্ৎসনায় সে একটুও লজ্জিত নয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী দুই সদস্য চীন ও রাশিয়া শুরু থেকেই মিয়ানমারের পক্ষে। আমেরিকা, চীন এমনকি বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ভারত কৌশলে নীরব হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল আছড়ে পড়ার তিন বছর শেষে তাদের মতিগতি আরো পরিস্কার হয়েছে। গত ২৫ আগস্ট একটি আন্তর্জাতিক ই-আলোচনায় আমাদের পররাষ্ট্রসচিব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সফল করতে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় বেসামরিক তদারকিতে রাখাইনে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ জন্য তিনি আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়ার আহŸান জানিয়েছেন। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। বরং নেপথ্যে চাপের বদলে মেনে নেয়া, সয়ে যাওয়ার পরামর্শও দেয়া হচ্ছে। গত তিন বছরে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে হতাশাই বাড়বে। বোদ্ধামহল ভাল করেই জানেন, নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ কখনোই বাস্তবায়িত হবে না। ভেটো ক্ষমতার অধিকারী নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়াকে রাজি করাতে না পারলে নিরাপত্তা পরিষদে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত আশা করা যায় না। চীন ও রাশিয়া সম্মত না হলেও এ ধরনের প্রস্তাবে তাদের ভেটো দেওয়া থেকে বিরত রাখার কোনো চেষ্টা আমাদের তরফ থেকে আছে কিনা, তাও আমরা জানি না। আন্তর্জাতিক বিশ্বের অন্য যারা মাঝেমধ্যে মিয়ানমারকে টুকটাক চাপ দিতো তারাও করোনাকালে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুসরত পাচ্ছে না। বাংলাদেশের লবি, দেন-দরবার, তদ্বিরও যেন থমকে গেছে। এই সুযোগে ক‚টনীতির মারপ্যাঁচে কোনঠাসা না হয়ে জবরদস্তিমূলক আচরণ করে যাচ্ছে মিয়ানমার। রাখাইনে গত কিছুদিন ধরে যে বিধ্বংসী অভিযান ও নিষ্ঠুরতা চলছে তা নিয়ে টু শব্দও হচ্ছে না। এবার ২৫ আগস্টে সরবে তৃতীয় রোহিঙ্গা জেনোসাইড রিমেম্বার ডে পালন করেনি রোহিঙ্গারা। এর আগে, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বড় আকারে সমাবেশ আয়োজন, মসজিদে মসজিদে দোয়া, ব্যানার ফেস্টুন, টি শার্ট ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক পরিসরে দিনটি পালন করে বিশ্বগণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল রোহিঙ্গারা। এবার করোনা পরিস্থিতি দৃষ্টে সেই ধরনের কিছুতে যায়নি তারা। রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরকান রোহিঙ্গা সোসাইট ফর পিস অ্যান্ড হিউমিনিটি- এআরএসপিএসের নেতাদের মতিগতি রহস্যজনক। টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যা¤পগুলোতে রোহিঙ্গা সংগঠন ভয়েস অব রোহিঙ্গা, স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, রোহিঙ্গা স্টুডেন্ট নেটওয়ার্ক, রোহিঙ্গা ইয়ুথ ফর লিগ্যাল অ্যাকশন, রোহিঙ্গা ইয়ুথ ফেডারেশন, রোহিঙ্গা কমিউনিটি ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম, এডুকেশন ফর রোহিঙ্গা জেনারেশন, রোহিঙ্গা ওমেন ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস ইত্যাদি সংগঠনগুলো বেশ তৎপর। অসহায় হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্ব যেন কেটে গেছে। এরা এখন চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক-অস্ত্র ব্যবসা, মানবপাচারসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। গত তিন বছরে বিভিন্ন থানায় দেড় হাজারের মতো মামলা হয়েছে তাদের নামে। অপকর্মের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় মাঝেমধ্যে ক্রসফায়ার করতে হচ্ছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেয়ার পর স্থানীয় পর্যায়ের সহযোগিতা এখন বিশ্বপরিসরেও ছড়িয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাদের এখন বহু হিতাকাক্সক্ষী। চতুরমুখী আশীর্বাদে রোহিঙ্গাদের অপকর্ম এখন আর ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যা¤প বা আশপাশে সীমিত নয়। এক সময় তাদের প্রতি যাদের সহমর্মীতা-ভালোবাসা কাজ করতো তারাও এখন তাদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে দফায় দফায় ঠাঁই নেয়া ১০ লাখ রোহিঙ্গার দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে ব্যয়ের জোগান আসছে। এছাড়া ত্রাণ বা সহায়তা বাবদ রোহিঙ্গাদের পেছনে দাতা গোষ্ঠী বা অন্য কোনও সূত্র থেকে আর্থিক সহায়তা আসছে। এর বাইরে রোহিঙ্গাদের জন্য সরকার ব্যয় হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই হিসাবে গত তিন বছরে রোহিঙ্গাদের পেছনে সরকারের সরাসরি ব্যয়ের পরিমাণ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় নামে সরকার। শুরুতে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি আঞ্চলিক শক্তিগুলো যেমন আসিয়ান, ভারত, চীন, কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় যেমন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, মানবাধিকার কাউন্সিলসহ অন্যান্য যেসব মেকানিজম আছে সব জায়গায় ধরনা দিয়েছে। কিন্তু চেষ্টার ফলাফল অনুক‚লে নয়।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের অবস্থান ও সংখ্যা নিয়েও বির্তক রয়েছে। বলা হয়ে আসছে, কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় নেয়ার কথা। তাদের প্রায় ৯ লাখ এসেছে ২০১৭-এর আগস্টের পরে। এর আগে ২০১৬ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অপারেশন শুরু করলে ও ২০১২ সালে রাখাইনে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হলে অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে। এর আগে ১৯৯২ সালে যে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছিল তাদের মধ্যেও ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা এখনও বাংলাদেশে অবস্থান করছে। কিন্তু, সবার ঠিকানা মিলছে না। প্রত্যাবাসনের জন্য যাচাই-বাছাই করতে সরকার পাঁচ দফায় আট লাখ ৫৩ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমার সরকারকে দিয়েছিল। প্রথম দফায় আট হাজার ৩২ জনের মধ্যে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৮৪ জনের। দ্বিতীয় দফার ২২ হাজার ৪৩২ জনের মধ্যে যাচাই-বাছাই হয়েছে মাত্র চার হাজার ৬৫০ জনের। অর্থাৎ ১০ লাখের মধ্যে ১০ হাজারেরও যাচাই বাছাই শেষ করেনি মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারে নিরাপদ অঞ্চল বা সেফ জোন প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে বাংলাদেশ যে ¯পষ্ট এবং জোরালো অবস্থান তুলে ধরতে পারেনি। সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবেও কেন বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা গেল না? সাধারণ পরিষদে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়ে যে প্রস্তাব পাস হয়, তার পক্ষে ভোট পড়েছিল ১৩৪ এবং বিপক্ষে ৯। ভোটদানে বিরত ছিল ২৮টি দেশ। রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধ, সহিংসতার নিন্দা এবং নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাবেও ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী ভারতের সমর্থন আদায় করা যায়নি। এ ছাড়া জাপান ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার (আঞ্চলিক জোট আসিয়ানভুক্ত) দেশগুলোর মধ্যে বিশেষত বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোও প্রস্তাবটিতে সমর্থন দেয়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সই করা বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক অকার্যকরই হয়ে আছে। একজন রোহিঙ্গারও প্রত্যাবাসন হয়নি। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় ও মানবিক জীবনযাপনের জন্য যে পরিমাণ অর্থের সংস্থান প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। বিদেশী সহায়তা ক্রমেই কমছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত আইসিজে গাম্বিয়ার আবেদনের শুনানি করে গণহত্যা সনদের বিধানের আলোকে মিয়ানমারে এখনো যেসব রোহিঙ্গা রয়ে গেছে, তাদের সম্ভাব্য গণহত্যা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার একটি অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করেছেন। সেই আদেশ বাস্তবায়নে দেশটি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তার ওপর প্রথম প্রতিবেদনটিও গত মে মাসে আদালতের কাছে জমা পড়েছে। আইসিজের রায় বাংলাদেশের জন্য কিছুটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আইসিজেতে প্রতিবেদন দেওয়ার ঠিক মাস দেড়েক আগে গত ৮ এপ্রিল জাতিসংঘের গণহত্যা সনদ মেনে চলা এবং রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সব সহিংসতার সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণের জন্যও দেশটির প্রেসিডেন্ট এক নির্দেশনা জারি করেন। নির্দেশনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাক্ষ্যপ্রমাণ ধ্বংস করা হলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। রাখাইন রাজ্যে এখনো নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনেও রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের অধিকার দেওয়া হয়নি। অথচ আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে আমাদের সরকারের উচিৎ এখন ক‚টনৈতিক চেষ্টা বাড়িয়ে দেয়া। চীন আমাদের ভাল বন্ধু। তার সাথে জোর কূটনীতি চালিয়ে গেলে সফল হওয়া সম্ভব। মিয়ানমারের নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন সরকারের সরব হওয়া উচিৎ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
a aman ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ২:২০ এএম says : 0
Burma will never take these rohinga back , only way to help them fight fr their right , like other parts in burma its happening.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন