নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লরার বায়তুস সালাত মসজিদে গত শুক্রবার রাতে যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তাতে সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা সবাই মারাত্মাক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে। যারা বেঁচে আছে, তাদের অবস্থাও আশংকজনক। মৃত্যুর সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। এই আকস্মিক ও মর্মান্তিক মৃত্যু ও আহতের ঘটনায় আমরা গভীরভাবে শোকাহত। তল্লা এলাকার ঘরে ঘরে এখন চলছে শোকের মাতম। এ শোক ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। কিসে এবং কেন এই বিস্ফোরণ, এখনো সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। এনিয়ে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়া গেলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে আশা করা যায়। প্রথমে বলা হয়েছিল, মসজিদের এসির বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ড ঘটেছে। পরে এ ধারণা ভিত্তি পায়নি। মসজিদে থাকা সবগুলো এসিই পুড়ে গেছে। তবে সেগুলো বিস্ফোরণে হয়েছে, এরূপ প্রমাণ মেলেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাধারণত এসিতে বিস্ফোরণ ঘটেনা। এতে সামান্য গ্যাস থাকে বটে, তবে তা খুব একটা দাহ্য নয়। তাতে এত মানুষ অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কথা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড: সাইয়েদ মাহমুদ উল্লাহ জানিয়েছেন, এসিতে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা কম। সরেজমিন পর্যবেক্ষণ ও আলামতাদি প্রত্যক্ষ করে এবং সংশ্লিষ্টদের মতামত শুনে সাধারণভাবে এই ধারণা জন্মেছে যে, এসির বিস্ফোরণ নয়, গ্যাস বিস্ফোরণেই এ মর্মন্তদ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।
কারণ খুঁজতে গিয়ে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা বিস্ময়কর। মসজিদে গ্যাসের কোনো সংযোগ নেই। তবে মসজিদের মেঝের নিচ দিয়ে গ্যাসলাইন নেয়া হয়েছে। মসজিদ নির্মাণের আগে সেখানে গ্যাসলাইন ছিল। তা না সরিয়েই তার ওপর মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। এটা মসজিদ কমিটি ও তিতাস গ্যাস কোম্পানির অসতর্কতা ও দায়িত্বহীনতার কারণেই সম্ভব হয়েছে। জানা গেছে, কিছুদিন আগে মসজিদের মেঝেতে গ্যাসের লিকেজ ধরা পড়ে। মসজিদ কমিটির তরফে বিষয়টি নারায়ণগঞ্জ তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, ৫০ হাজার টাকা না দেয়ায় তিতাস কর্মকর্তারা মসজিদের লিকেজ সারেননি। নারায়ণগঞ্জের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ আরেফিন জানিয়েছেন, মসজিদের সামনে গ্যাসের লাইনে লিকেজ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, এসি চালানোর সময় জানালা-দরজা বন্ধ থাকায় ওই গ্যাস ভেতরে জমা হয়ে যায়। হঠাৎ কেউ বৈদ্যুতিক সুইচ অফ অন করতে গেলে স্পার্ক থেকে বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। তিনি এও জানিয়েছেন, পানি দেয়ার সময় মসজিদের মেঝেতে বুদবুদ করে গ্যাস বের হচ্ছিল, যা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষও পরে প্রত্যক্ষ করেছে। অমনোযোগ, অবহেলা ও দায়িত্বশীলতার অভাব কী ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, মসজিদে বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনা তার একটি বড় প্রমাণ। উল্লেখ করা যেতে পারে, গ্যাস লিকেজজনিত বিস্ফোরণে মানুষের হতাহত হওয়ায় ঘটনা এই প্রথম নয়। আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যদিও মসজিদে এমন ঘটনা এই প্রথম। গত বছর কোরবানীর ঈদের দু’দিন পর শনিরআখড়ায় এক্সিম ব্যাংকে জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণে দু’জন মারা যায়। ওই ব্যাংকের নিচ দিয়েও গ্যাসলাইন ছিল। তার লিকেজ থেকে গ্যাস জমে ওই বিস্ফোরণ ঘটে। মাটির নিচে গ্যাসলাইন, তার ওপর বাড়িঘর, দোকানপাট, রাস্তাঘাট ও স্থাপনা তৈরির ঘটনা অসংখ্য বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার আশকাংও তাই এড়িয়ে যাওয়া যায়না।
অর্ধশতাব্দীকাল আগে তিতাস গ্যাসের সরবরাহ শুরু হয়। সেই সময় যেসব পাইপলাইন বসানো হয়, আজ পর্যন্ত তার প্রতিস্থাপন বা পরিবর্তন হয়নি। পরবর্তীতে দিনে দিনে গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে, লাইনের সম্প্রসারণ হয়েছে। পুরানো লাইন দুর্বল হয়েছে, ভেঙ্গে গেছে বা তাতে ছিদ্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু সংস্কার ও মেরামত হয়নি। লাইনের বেশিরভাগ বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এক তথ্য জানা যায়, সারাদেশে গ্যাসলাইনের পরিধি ২৪ হাজার ২৮৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে বিতরণ ও সার্ভিস লাইন ২০ হাজার কিলোমিটার, যার ৭০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম পত্রিকান্ত বলেছেন, আগে মালামাল ভালো ছিল, যে কারণে এখনো চলছে। পরবর্তীকালে বসানো লাইনের গুণগত মান ভালো নয়। দু’দিনের মধ্যে লিকেজ হচ্ছে, এমন নজিরও আছে। অন্যদিকে গ্যাসের কোয়ালিটিরও পরিবর্তন হয়েছে। গ্যাসের মধ্যে এখন তরল থাকে। সঞ্চালন ব্যবস্থাও অত্যন্ত নাজুক। দেশের সকল বিতরণ কোম্পানির আওতাধীন এলাকায় মসজিদ-মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎসংযোগ ও এসির অবস্থা পরীক্ষা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। নির্দেশটি ইতিবাচক তবে এর পরিধি বাড়ানো দরকার। সকল বাড়িঘর, হাসপাতাল, দোকান-মার্কেট ও স্থাপনা এই নির্দেশের আওতায় আনা উচিৎ। একই সঙ্গে গ্যাসলাইনের বিষয়টিও সংযুক্ত করা প্রয়োজন। গ্যাসলাইনের বেশিরভাগ ঝুঁকিপূর্ণ থাকা মানে সর্বক্ষণ বিপদের আশংকার মধ্যে থাকা। দু:খজনক হলেও বলতে হচ্ছে, গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে তিতাসের জুড়ি নেই। অথচ সেবার নামে লবডংকা। তিতাসের সর্বস্তরে বিশেষত নিচের দিকে দুর্নীতি ওপেন সিক্রেট। গ্যাসসংযোগ বন্ধ থাকায় এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজও অনেক কম। এমতাবস্থায়, লাইন দেখাভাল করা, প্রয়োজনে সংস্কার করা ইত্যাদির পাশাপাশি সেবার মান বাড়ানোর দিকে তাদের অধিক নজর দেয়া উচিৎ। তিতাসকে একটি দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক ও গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি। আমরা আশা করবো, গ্যাসলাইন মেরামত, সংস্কার ও প্রতিস্থাপনে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে। পরিশেষে মসজিদে বিস্ফোরণে যারা নিহত হয়েছে, আমরা তাদের আত্মার মাগফেরাত ও আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। তাদের পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন