বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

নিষিদ্ধ পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার

পুরান ঢাকায় অবৈধ কারখানার ছড়াছড়ি, প্রশাসন নীরব

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০৪ এএম

যত্রতত্র ফেলায় বন্ধ হচ্ছে ড্রেন, বাড়ছে পানিবদ্ধতা, ব্যাহত পয়ঃনিষ্কাশন 
বন্ধে সরকারের সদিচ্ছার অভাব : বাপা 
পানিতে গেল ১,১২৫ কোটি টাকা, বুড়িগঙ্গায় জমেছে পলিথিনের ৭ ফুট স্তর


সকাল ১০টা। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবুল কাশেমের হাতে কয়েক প্রকার তরিতরকারী, মাছ ও ডাল। প্রতিটি পণ্যই পলিথিনের ব্যাগে ভরা। নিষিদ্ধ পলিথিন কেন হাতে? এমন জিজ্ঞাসায়Ñ তিনি প্রথমে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। পলিথিনের দিকে ইঙ্গিত করতেই বললেন, ‘বাজারে তো পলিথিন ছাড়া অন্য কিছু নেই। কিসে নিব তাহলে?’

গত ৯ সেপ্টেম্বর শাহজাহানপুর মৈত্রী সংঘের মাঠের বাজারে কথা হয় আবুল কাশেমের সঙ্গে। পলিথিনের খারাপ দিক জানেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা জানি পলিথিন পচে না, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। কিন্তু চারদিকেই তো পলিথিন আর পলিথিন। বন্ধ করার তো কোনো ব্যবস্থা দেখি না। অন্য ব্যবস্থা থাকলে সেগুলোই ব্যবহার করতাম।

উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার নিষিদ্ধ; অথচ সবার হাতে হাতে পলিথিন। নিত্যদিনের বাজার সদাই মানেই পলিথিনের ব্যবহার। নিষিদ্ধ পলিথিনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবেশের। ঢাকার পানিবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ পলিথিন। বুড়িগঙ্গা নদীর তলদশে ৭ ফুট পলিথিনের স্তর। সর্বনাশা পলিথিনের কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা এসব নদী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ পলিথিন ঠেকাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। পলিথিন দমনে বছরের পর বছর শুধু অভিযান চলে। এসব অভিযানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জরিমানা ও কারাদÐ দেওয়া হয়। তবে পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয় না। বরং দিনকে দিন এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার সবই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, পলিথিনসহ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সব কিছুর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাট-বাজরে পলিথিনের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে।

বাংলাদেশে প্রতিদিন কী পরিমাণে পলিথিন উৎপাদন, ব্যবহার বা বর্জ্য হিসেবে জমা হয় এ নিয়ে সরকারি কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বা হিসাব নেই। তবে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) এক পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ২ কোটির বেশি নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যাগ বর্জ্য হিসাবে জমা হয়। এসব বর্জ্য ঢাকার ড্রেনেজ সিস্টেম, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিকল করে ফেলে। এর ফলে প্রতি বছরই পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা মেরামত করতে হয়। এতে প্রচুর অর্থের অপচয় হচ্ছে। বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে পলিথিনের স্তর সরাতে এর খনন কাজে ১ হাজার ১২ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অথচ এতে কোনো কাজই হয়নি। এ নদীর তলদেশে আবার ৭ ফুট পুরো পলিথিনের স্তর জমেছে।

বর্তমানে সাধারণ মুদিদোকান, বাজার, শপিং সেন্টার, লাইব্রেরি, ফুটপাথের দোকান এবং রেস্টুরেন্টসহ সর্বত্রই পণ্য বিক্রিতে ব্যবসায়ীরা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিব্যাগ ব্যবহার করছেন। বলা যায়, আইন উপেক্ষা করে রাখঢাক না করেই এই ব্যবসায়ীরা পলিথিন ব্যবহার করছেন, এমনকি সচেতন ক্রেতারা আইন আমলে না নিয়ে পণ্য ক্রয়ের সময় বিক্রেতার কাছে পলিথিনের ব্যাগই চাইছেন। ঢাকার আশপাশের এলাকার রাস্তাঘাট, অলিগলি, ডোবা-নালা, ড্রেন, নর্দমা এখন ফেলে দেওয়া পলিথিন ব্যাগে সয়লাব। অপচনশীল পলিথিনে ভরাট হচ্ছে পয়ঃনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা। আর তাতে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ধূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ ছাড়া চাপাপড়া পলিথিন নষ্ট করছে মাটির গুণাগুণ। পলিথিন বা প্লাস্টিক বর্জ্যে নদী থেকে সাগরের পানি পর্যন্ত দূষিত হচ্ছে। পরিবেশবিদের মতে, যত্রতত্র পলিথিন নিক্ষেপের ফলে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছেÑ পানি, মাটি ও বাতাস। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে চর্মরোগে। এ ছাড়া পলিথিনের অবাধ ব্যবহারের কারণে ঢাকার ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

সরকারিভাবে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা এবং একই বছর ৮ এপ্রিল সারা দেশে এইচডিপিই (হাইয়ার ডেনসিটি পলি ইথালিন) পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধনী ২০১০) অনুযায়ী নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণের অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছরের সশ্রম কারাদÐ অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দÐের বিধান আছে। আইনের প্রয়োগ না থাকায় সেই পলিথিনের বিক্রি ও ব্যবহার থামানো যায়নি এক বিন্দুও। ফলে নিত্যপণ্যের বাজারে পলিথিনের আধিপত্য এখন চরম পর্যায়ে। এমনকি পলিথিন ব্যাগে করে খাবার আনা-নেওয়া, হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে গরম খাবার বহন করা, ফ্রিজে পণ্য রাখতেও ব্যাপকভাবে পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে পলিথিনের ব্যবহার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বহুদিন আগেই। বেড়েছে রোগব্যাধি, অকাল মৃত্যু।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশ অধিদফতরের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণেই বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। পলিথিন ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে খিলগাঁও রেলগেইট কাঁচাবাজারের এক মাছ বিক্রেতা ছালাম বলেন, ‘কাস্টমার পলিথিন ছাড়া মাছ নিতে চায় না। এ জন্য আমরাও পলিথিনের ব্যাগে মাছ বিক্রি করি।’ কয়েকজন তরিতরকারী বিক্রেতা ও মুদি দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্রেতারা জিনিস কেনার পর তা পলিথিনের ব্যাগে করেই বাড়িতে নিয়ে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অধিকাংশ ক্রেতা নেটের ব্যাগ বা পাটের ব্যাগের পরিবর্তে পলিথিনের ব্যাগেই পণ্য নিতে চান। ফল বিক্রেতা খোরশেদ জানান, ক্রেতারা পলিথিনের ব্যাগ ছাড়া ফল কিনতে চায় না। পলিব্যাগ রাখলে মাঝেমধ্যে পুলিশ ঝামেলা করে কিন্তু না রাখলে ব্যবসার ক্ষতি হয়। তাই বাধ্য হয়ে রাখি।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় এক হাজার ২০০ কারখানা রয়েছে। যার বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। শুধু পুরান ঢাকার অলিগলিতে আছে অবৈধ ৩০০ কারখানা। পবার তথ্যমতে, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, টঙ্গীতে ছোট-বড় বেশকিছু কারখানা আছে। আর যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। আর ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আছে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। পলিথিন বাজারজাতকরণে ‘পরিবহন সিন্ডিকেট’ নামে আরেকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেটটি এই পলিথিনগুলো ওপরে ‘জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত’ লেখা ট্রাকে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দিচ্ছে।

পুরান ঢাকার ইসলামবাগ ক্লাবঘাট রোডে শাহীন বিরিয়ানির উল্টোপাশের গলিতে আছে অন্তত পাঁচটি পলিথিনের কারখানা। গলির ডানদিকের দ্বিতীয় ভবনের নিচতলায় জাহাঙ্গীরের, দোতলায় কামালের কারখানা ছাড়াও শেষপ্রান্তে সেলিমের ও জসিমের কারখানার পাশেই আছে জয়নালের কারখানা। ক্লাবঘাট হাজীবাড়ির মসজিদের পাশের ভবনের প্রথমতলা হতে তৃতীয়তলা পর্যন্ত আলম, আজিজ ও মামুনের তিনটি কারখানা আছে। কামালবাগ জোড়া হাতির গলিতে চার ভাই সোবহান, রেজাউল, লিয়াকত ও জাহাঙ্গীরের আছে ৪টি কারখানা। কথা বলতে চাইলে তারা এড়িয়ে যান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জানান, কারখানাগুলোতে দিনে নামমাত্র প্যাকেজিংয়ের কাজ হলেও রাতে চেহারা পাল্টে যায়। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত চলে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন। পরে ‘জরুরি রফতানি কাজে নিয়োজিত’ স্টিকারযুক্ত কাভার্ডভ্যানে করে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত মাসোয়ারা দেওয়ার মাধ্যমেই ব্যবসায়ীরা এ অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

পলিথিনের ব্যাপকক্ষতির বিষয়টি বিবেচনা করে উচ্চ আদালত এক বছরের মধ্যে পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার, বহন, বিক্রি ও বাজারজাতকরণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ (বেলা) ১১টি সংগঠনের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত এ আদেশ দেন।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ইনকিলাবকে বলেন, সরকার আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধ করল। তখন পলিথিন ব্যবহার কমে এসেছিল। তারপর আবার বাজারে পলিথিন চলে এল। যেহেতু আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না, সে জন্যই আমরা মামলা করেছি। আমরা চাই, সরকার একটা কর্মপরিকল্পনা নিক যাতে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল ইনকিলাবকে বলেন, সর্বনাশা পলিথিনি বন্ধ করতে হলে একটি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে সরকারের সদিচ্ছার প্রয়োজন। বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এটা বন্ধের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছার বড় অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। পলিথিন বন্ধ করতে হলে শিল্প মন্ত্রণালয়কে এর উপাদন বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তরকে বাজার মনিটর করতে হবে। যারা এর ব্যবহারকারী তাদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়াতে হবে। এর ভয়ানক ক্ষতিকারক প্রভাবের কথা মানুষকে বুঝাতেহবে। সব মিলিয়ে একটি সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ নিলে সেটা ফলপ্রসূ হবে। তবে বাস্তবে সেটা আমরা দেখছি না। পলিথিন বন্ধের বিষয়ে সরকারের আন্তরিকতা বা সদিচ্ছার অভাব আছে বলেই আমাদের মনে হচ্ছে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন