স্টালিন সরকার : ঈদুল আজহা আসছে। ক’দিন পর শুরু হবে কোরবানির পশু নিয়ে আলোচনা। গরু, খাসি, মহিষ, ভেড়া, উট- সবগুলো কোরবানির পশু হলেও আলোচনায় থাকবে গৃহপালিত নিরীহ পশু গরু। এবার দেশেই প্রচুর গরু রয়েছে। কুষ্টিয়া, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, মুন্সিগঞ্জ, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলায় খামারিরা বাণিজ্যিকভাবে গরু প্রতিপালন করছেন ঈদে বিক্রির লক্ষ্যে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার কোরবানির ঈদে খামারিরা গরুর ন্যায্য মূল্য পেলে আগামীতে সারাবছর এবং কোরবানির ঈদে গরুর গোশতে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। কিন্তু কোরবানির ঈদের আগে সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু প্রবেশ করলে দেশের খামারিরা মার খাবে। কৃষক ও খামারিরা বাণিজ্যিকভাবে গরু প্রতিপালনে আগ্রহ হারাবে। ঈদের এক মাস বাকি থাকায় দেশে ‘গরু’ আলোচনায় না এলেও ভারতের গরু নিয়ে চলছে তোলপাড়। ওই দেশের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা গরুকে ‘মা’র মর্যাদা দিতে গিয়ে গৃহপালিত নিরীহ পশু গরুর সর্বনাশ করছে। গরু বিক্রি করতে না পেরে কৃষকরা দিশেহারা। গরু মরে যেখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে। খাদ্যাভাবে একদিনে ৫শ গরু মারা গেছে। গরু নিয়ে ভারতের রাজনীতি কার্যত এখন বেশ ‘গরম’।
গরু নিয়ে বাড়াবাড়িতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কর্মযজ্ঞের মূল্যায়ন করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, নরেন্দ্র মোদির কাজ শুধু গরু গণনা করা। তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাগড়া দেয়ায় মানুষের প্রতি মমতা ব্যানার্জীর ‘মায়া-মমতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও কট্টর হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের ভাবশীষ্য মোদির যে তিনি যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ ইস্যুতে বিগত কংগ্রেস সরকারের অপরিণামদর্শী ফাউল খেলায় নির্বাচনে ভরাডুবিতে যারা মনে করেছিলেন বিজেপি প্রতিবেশীর সঙ্গে ফাউল খেলবেন না, তারা এতদিনে খনার বচন ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না; ইজ্জত ধুলে খাসলত যায় না’ স্মরণ করছেন। ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার ইতোমধ্যেই আরএসএস ও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের একহাত নিয়েছেন।
নতুন খবর হলো, ভারতের রাজস্থানে সরকার পরিচালিত একটি ‘গোশালায়’ অনাহারে ৫শ গরু মারা গেছে। মায়ের মর্যাদা দেয়ায় যেখানে গোটা ভারতে গরু হত্যা নিষিদ্ধ করতে চাইছে বিজেপি, সেখানে গৃহপালিত পশুর প্রতি এই নির্মমতা নিয়ে সরব হয়েছে বিরোধীরা। রাজস্থানের হিঙ্গোনিয়ার ‘গোশালায়’ কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট করছে শ্রমিকরা। এতে ওই ফার্মের গরু দেখভাল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। না খেয়ে মারা যায় ৫শ’রও বেশি গরু। এর আগে গুজরাটে মরা গরু সরানো নিয়ে নি¤œবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে বিরোধে শত শত মৃত গরু রাস্তায় পড়ে থাকে। মরা গরুর দুর্গন্ধ নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে যায় সেখানকার উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। এ নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে যান নরেন্দ্র মোদি। তিনি বেজায় চটে যান আরএসএসে আস্কারা পেয়ে যারা গরুর গোশত খাওয়া নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করেছে, গরুর গোশত খেয়েছে শুনে মুসলমানদের হত্যা করেছে, তাদের ওপর। ৫শ গরু মারা যাওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গো রক্ষা কমিটিকে সমাজবিরোধী আখ্যা দিয়ে বলেছেন, কিছু লোক আছেন যারা রাতের বেলায় সমাজবিরোধী অপকর্মে লিপ্ত থেকে দিনের বেলায় গো রক্ষার মুখোশ পড়েন। আমি নিশ্চিত এদের ৭০ থেকে ৮০ ভাগই অপকর্মে লিপ্ত। তাই এই ধরনের ‘গো রক্ষাকারীদের’ বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিচ্ছি।
বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর কট্টর হিন্দুদের নিয়ে গঠিত হয় গো রক্ষা কমিটি। গরুকে ‘মা’ মর্যাদা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে গৃহপালিত গরু হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়। শুধু তাই নয়, অনেক রাজ্যে গরুর গোশত খাওয়া আইনগতভাবে দ-নীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। তিনি সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফকে নির্দেশ দেন, ‘আপনারা নজরদারি আরো বাড়িয়ে দিন যাতে গরু পাচার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মোদির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বিজেপি এমপি শঙ্কর ভাই এন সংসদে বলেন, ‘গোহত্যা আসলে মহাপাপ। বেদ-এ গরুকে মা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আর দেশের কেউ কেউ সেই গরুর মাংস খান। কী হচ্ছে এসব! ভারত মা তথা গরুদের রক্ষা করতে না পারলে দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। বিজেপি’র ওই এমপি সংসদে দাঁড়িয়ে দাবি করেন, ‘গরুর মূত্র খেলে ক্যান্সার রোগ সম্পূর্ণ সেরে যায়। মানুষের সবচেয়ে উপকারী পশু গরুকে রাষ্ট্রীয় মা স্বীকৃতির দাবি তোলেন ভারতের সংসদে বিজেপির আরেক এমপি যোগী আদিত্যনাথ। এরা সবাই মোদির মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের ভাবশীষ্য। সাম্প্রতিক সময়ে সেই গরু জবাই ও গোশত বহনের দায়ে বহু মানুষকে নির্যাতন করা হয়। মুসলমানদের পাশাপাশি গরু নিয়ে নির্যাতনের শিকার হন অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও। গত মাসে মৃত গরুর চামড়া ছাড়ানোর অপরাধে দলিত সম্প্রদায়ের ৪ জনকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে গুজরাটের গো রক্ষা কমিটি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গুজরাটের মানুষ ফুঁসে ওঠে। মূলত বিজেপি ক্ষমতায় আসা এবং মোদির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পরে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে গরু জবাইকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সংহিসতা ছড়িয়ে পড়ে। গরুর গোশত রাখার মিথ্যা অভিযোগে উত্তর প্রদেশের এক মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সে খবর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়। আমেরিকা এ ঘটনার উদ্বেগ প্রকাশ করে তীব্র নিন্দা জানায়। এতকিছুর পরও এতদিন নীরব থাকলেও এখন পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নরেন্দ্র মোদি রাজ্য সরকারকে গো রক্ষা কমিটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে গরু গণনার নামে পশ্চিমবঙ্গে বিপজ্জনক রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরির অভিযোগ তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। তিনি বলেছেন, বিজেপির মতলব গরু ইস্যু নিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো। গেরুয়াধারীরা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় গো রক্ষা সমিতি করে গরু গণনা করছে। সামনেই কোরবানির ঈদ। তার আগেই বিজেপির গেরুয়াধারীরা মাঠে নেমে পড়েছেন গরুর তথ্য সংগ্রহে। মোদি কি গরু গণনা করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে চান? এ প্রশ্ন তুলেছেন মমতা ব্যানার্জী।
ভারত থেকে সীমান্তপথে বাংলাদেশে গরু প্রবেশ দেড় বছর ধরে বন্ধ। অনেকের ধারণা ছিল ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হলেই দেশে কারবানিতে গরুর সংকট সৃষ্টি হবে। সঙ্গে বাড়াবে দামও। গরুর জন্য রীতিমত হাহাকার পড়ে যাবে। বাস্তব পরিস্থিতি তেমন নয়। গত বছর ভারত থেকে গরু তেমন না আসার পরও কোরবানির বাজারে গরুর দাম ছিল কম এবং দেশের খামারিরা ন্যায্য মূল্য পেয়েছে। বাজারে গরুর সংকট হয়নি। ভারত সীমান্তে কড়াকড়ির করায় সরকারি বিশেষ প্রণোদনায় মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান থেকে কোরবানির গরু এবং অন্যান্য পশু আমদানি করা হয়। যার কারণে গরু না দিয়ে ভারত যে বাংলাদেশকে বিপদে ফেলতে চেয়েছে, উল্টো ভারতই উচিত শিক্ষা পেয়েছে। ভারতের কৃষকরা গরু রফতানি করে যে আর্থিক লাভ করত সেটা থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, দেশে প্রতিবছর কোরবানির গরুর চাহিদা তৈরি হয় সর্বোচ্চ ৪০ লাখ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যে দেখা যায়, দেশে এখন গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৮৬ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭৫ লাখ গাভী। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও গোশত ব্যবসায়ীদের হিসাবে দেশে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো গরু ও মহিষ জবাই হয়। এর ৬০ শতাংশই হয় কোরবানির ঈদে। কোরবানির জন্য এবার ৩০ থেকে ৩৫ লাখ গরু ও ৬৯ লাখ ছাগল-ভেড়া ও মহিষ রয়েছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ আসবে নিজস্ব উৎপাদন থেকে। কোরবানির সময় চাহিদার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ঘাটতি থাকে। এ সুযোগে এতদিন কোনো রকম স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই গরু আসত ভারত থেকে। আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে ৭০ লাখ পশু কোরবানির জন্য প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে নিজস্ব উৎস থেকে পাওয়া যাবে ৬০ থেকে ৬২ লাখ। বাকি ৮ থেকে ১০ লাখ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। ইতোমধ্যে ঘাটতির সিংহভাগ পূরণ হয়ে গেছে। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত গরু আসা অব্যাহত থাকবে।
ভারত গরু দেয়া বন্ধ করে দেয়ায় প্রথমে অনেকেই ‘সর্বনাশ’ মনে করলেও এখন কার্যত সেটা দেশের কৃষকদের জন্য ‘আশীর্বাদ’ হয়ে গেছে। আগে কোরবানির গরুর জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় খামারি ও কৃষকরা গরু প্রতিপালনে আগ্রহ দেখাতেন না। এখন শুধু খামারি নন কৃষকরাও ঘরে ঘরে গরু প্রতিপালন করছেন ঈদ উপলক্ষে। সারাবছর গরু প্রতিপালন করেন কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য। গত ঈদুল আজহায় ভারতীয় গরু কম থাকায় কৃষক ও খামারিরা প্রত্যাশিত দরে গরু বিক্রি করেছেন। অতঃপর তারা দ্বিগুণ উৎসাহে গরু প্রতিপালন শুরু করেন। এবার খামারিরা প্রচুর গরু প্রস্তুত করেছেন কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য। আর কৃষকরাও আগের চেয়ে বেশি গরু প্রতিপালন করেছেন। আগে যে কৃষক একটি দুটি গরু প্রতিপালন করেছেন এবার সেই কৃষক ৩ থেকে ৫টি গরু প্রতিপালন করেছেন। কাজেই ঈদের চাহিদা মেটাতে পারে দেশী গরুই। বরং দেশের কৃষক ও খামারিদের উৎসাহ দিতে ঈদুল আজহা পর্যন্ত সীমান্ত দিয়ে যাতে ভারতীয় গরু প্রবেশ করতে না পারে সে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ভারত তাদের গরু মাতাকে নিয়ে লম্ফঝম্ফ করুক, হৈহুল্লোর করুক। আমরা নিজস্ব উৎপাদন দিয়েই চাহিদা মেটাতে পারব। প্রসঙ্গক্রমে গরুর গোশত কেনাবেচার তথ্য জানাতে গিয়ে একজন জানালেন, ২০১৫ সালে ঢাকার বাজারে গরুর গোশতের কেজি ছিল ২৮০ টাকা। সে গরুর গোশত এখন বিক্রি হচ্ছে ৪২০ টাকা দরে। মানুষ কিন্তু গোশত খাওয়া বন্ধ করেনি। অতএব গরু না নিয়ে ভারতকে শিক্ষা দেয়ার এখনই সময়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন