শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সঞ্চয়ী ব্যাংকে বেপরোয়া লুটপাট

| প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

ডাক বিভাগ পরিচালিত সঞ্চয়ী ব্যাংকের কত কোটি টাকা এ যাবৎ লোপাট হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে এই টাকা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ডাক বিভাগের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত। গত ৩১ বছর ধরে ব্যাংকটির রিকনসিলেশন বা হিসাবের সমন্বয় বিধান করা হয়নি। এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। যেহেতু এতদিনের পূর্বাপর কোনো হিসাব-নিকাশ নেই, সুতরাং কত কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টিভাবে বলা সম্ভব নয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়েছে। অথচ, এসব ঘটনার কথা ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়নি। ব্যাংকের টাকা লোপাটের পদ্ধতিগত ত্রু টি বন্ধের কোনো উদ্যোগ ডাক অধিদফতরের তরফে নেয়া হয়নি। উপরন্ত এ সংক্রান্ত প্রকল্পের ১২০ কোটি টাকা শেষ পর্যন্ত গচ্ছা গেছে বলে অভিযোগ। কথা ছিল, এই প্রকল্পের আওতায় ডাক বিভাগের যাবতীয় কার্যক্রম অটোমেটেড করা হবে। সব কিছুই আনা হবে একটি সফটওয়ারের আওতায়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে শুধুমাত্র ডাক সঞ্চয়পত্রগুলোকে অটোমেশনের অধীনে আনা হয়েছে। অর্থ আত্মসাতের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র সঞ্চয় ব্যাংককে অটোমেশনের বাইরে রাখা হয়েছে। সফটওয়ার কেনা হলেও চালু করা হয়নি। অর্থ আত্মসাতের পদ্ধতিগত ত্রু টি বন্ধে নেয়া প্রকল্পের পরিণতি এমন হওয়ার জন্য যারা দায়ী, যারা এর অর্থ পর্যন্ত নয় ছয় করেছে, তাদের কঠোর জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিকল্প নেই।

দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে টাকা আত্মসাতের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে নোয়াখালীর এক পোস্টাল অপারেটরের ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ, চট্টগ্রাম জিপিও’র সঞ্চয় শাখার পোস্ট মাস্টার ও অপারেটরের ৪৫ লাখ টাকা আত্মসাৎসহ এই শাখায় আরও ২৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ঢাকা জিপিও’র মানি অর্ডারের ৮০ লাখ টাকা আত্মসাৎ উল্লেখযোগ্য। এর আগে রংপুরের বিভাগীয় ডাক ঘর থেকে প্রায় ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয় এবং আত্মসাতকারীর চাকরি যায়। একের পর এভাবে আত্মসাতের ঘটনা ঘটতে থাকলেও আত্মসাতের পথ কিন্তু বন্ধ হয়নি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ৩১ বছর ধরে সঞ্চয় ব্যাংকের রিকনসিলেশন হচ্ছে না। রিকনসিলেশন হলে পূর্বাপর সমন্বিত একটি হিসাব থাকতো। না থাকায় ইচ্ছে মতো টাকা সরানো সম্ভবপর হচ্ছে। এ জন্য কাউকে জবাবদিহিতার মুখোমুখী হতে হচ্ছে না। টাকা আত্মসাৎ করার প্রক্রিয়া-পদ্ধতি এমন যে, সহজে ধরা সম্ভব নয়। টাকা আত্মসাতের উদ্দেশে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারী প্রথমে নামে-বেনামে সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর খুলে পাস বই নেয়। তাতে মোটা অংকের টাকা জমা দেখায় এবং একই অংকের টাকা লেজারে জ মা দেখায়। টাকা হাতিয়ে নেয়ার হাতিয়ার হিসাবে তিনি ব্যবহার করেন ওই দিনের সিডিউল বা জার্নাল। পাস বই ও লেজারে টাকা জমা দেখানো থাকলেই হয় না। একই সঙ্গে জার্নালেও জমা দেখাতে হয়। কারণ, জার্নালে বর্ণিত টাকাই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়। আত্মসাৎকারী পাস বই ও লেজারে জমা দেখায়, জার্নালে তা তোলে না। ফলে টাকা কোষাগারে জমা পড়ে না। পরে পাস বই দেখিয়ে টাকা তুলে নেয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী শুধু দেখে পাস বইতে টাকার পরিমাণ উল্লেখ আছে কিনা। এভাবেই সঞ্চয় ব্যাংকের টাকা লোপাট হচ্ছে। বাইরের কারো পক্ষে এভাবে টাকা আত্মসাৎ করার সুযোগ নেই।

এই টাকা চুরি বা আত্মসাৎ যে পদ্ধতিতে হচ্ছে তা বন্ধ হতে পারতো যদি প্রতিবছর রিকনিসিলেশন বা হিসাবের সমন্বয় সাধন করা যেতো। সরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাবের সমন্বয় বিধানের দায়িত্ব কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিঅ্যান্ড এজি)। ডাক বিভাগের হিসাবের সমন্বয় বিধান করতো সি অ্যান্ড এজির অফিস। কিন্তু তা বন্ধ রয়েছে ১৯৮৭ সাল থেকে। তখন জানিয়ে দেয়া হয়, লোকবলের অভাবে ডাক বিভাগের হিসাব সমন্বয়ের কাজ সম্ভব হচ্ছে না। এরপর এখনো পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। ডাক বিভাগের তরফে অতঃপর এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি অভ্যন্তরীণ অডিটও করা হয়নি। ডাক বিভাগকে অটোমেশনের আওতায় আনার প্রকল্পও ব্যর্থতার শিকার হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে একটি উত্তম বিকল্প কার্যকর হতে পারতো। প্রকল্পটির ব্যর্থতা ও অর্থ গচ্ছা যাওয়ার পেছনে কারা ভূমিকা রেখেছে, অনুমান করা কঠিন নয়। জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের তরফে সঞ্চয় ব্যাংক অটোমেটেড করার ব্যাপারে একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সে প্রকল্প কবে বাস্তবায়িত হবে এবং কবে নাগাদ সুফল পাওয়া যাবে বলার উপায় নেই। এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ কে হবে, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, সঞ্চয় ব্যাংক থেকে অর্থ আত্মসাতের ঘটনার তদন্ত ও বিচারে তেমন অগ্রগতি নেই। ২০০৮ সালে উদঘাটিত রংপুরে হাওয়া হয়ে যাওয়া প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকার বিষয়ে দুদক তদন্ত শুরু করলেও মাঝপথে থেমে যায়। পরেও আর এনিয়ে তদন্ত হয়নি। দুদকের তদন্ত থেকে সরে আসার বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে। সঞ্চয় ব্যাংকে দু’ ধরনের একাউন্ট আছে: সাধারণ ও মেয়াদী। সাধারণ মানুষ যেমন এ ব্যাংকে টাকা জমা রাখে, তেমনি সঞ্চয়পত্র বিক্রি, মানি অর্ডার, স্ট্যাম্প বিক্রি, পার্সেলের মাসুল ইত্যাদিও জমা হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকে টাকার নিরাপত্তা থাকবে না, জবাবদিহি থাকবে না; বেপরোয়া লুটপাট চলতে থাকবে, এটা হতে পারে না। এই আত্মসাৎকৃত অর্থের দায় কে নেবে? সরকারের ঘাড়েই তো চাপবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রিকনসিলেশন ছাড়া কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না, পাবলিক মানির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকতে পারে না। কাজেই সঞ্চয় ব্যাংকের রিকনসিলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। অভ্যন্তরীণ অডিট কার্যকর না থাকলে বাইরের কোনো কোম্পানির মাধ্যমে অডিট করতে হবে। সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ অডিট হলে এপর্যন্ত কত টাকা লোপাট হয়েছে তা জানা যাবে। কারা লোপাট করেছে তাও জানা যাবে। যারাই টাকা লুটপাটের সঙ্গে জড়িত, তারা যেই হোক, যেন রেহাই না পায়। অবশ্যই তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন