শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

করোনার চেয়ে সেনা ভয় বেশি রাখাইনে

‘ওই রাতে বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়েছে গ্রামের চারপাশে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে’

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

আতঙ্কের জনপদ রাখাইন। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো সেখানেও হানা দিয়েছে করোনা ভাইরাস। কিন্তু এই ভাইরাসের চেয়ে সেখানকার জনসাধারণ বেশি ভীত সেনাবাহিনীকে নিয়ে। অনলাইন আল-জাজিরায় প্রকাশিত সাক্ষাতকার ভিত্তিক এক প্রতিবেদনে এমনটাই ফুটে উঠেছে। থার হ্লা (৩২) নামে একজন বলেছেন ৩রা সেপ্টেম্বর রাতের কথা। তিনি বলেছেন, ওই রাতে তিনি প্রায় ৭০ জন মানুষের সঙ্গে একটি পাকা মেঝেতে ঘুমিয়েছিলেন। তার ঘুম আসছিল না। এর কারণ, ওই গাদাগাদি করে অবস্থান করা নয়। থার হ্লা বলেন, আকিস্মকভাবে গুলির শব্দ পেলাম। মনে হলো এই কোয়ারেন্টিন সেন্টারটা নিরাপদ নয়। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের কাউকতায় নিজের বাড়ি থেকে টেলিফোনে তিনি বলছিলেন, ওই গুলির শব্দে সেই রাতে কেউ ঘুমাতে পারেননি। পরের সকালে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার রিপোর্ট আনতে গেলেন কিছু মানুষ। তারা গেলেন তো গেলেনই। কোয়ারেন্টিন সেন্টারের সবাই যার যার বাড়ি চলে গেলেন। ওই রাতে দুটি গ্রামে হামলা চালানো হয়েছিল। এর একটি গ্রামের ইউ ইয়েট থি আল-জাজিরাকে বলেছেন, তার গ্রাম থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে ওই কোয়ারেন্টিন সেন্টার। সেখান থেকে সেদিন সবাই পালিয়েছিল। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ওই রাতে বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়েছে তাদের গ্রামের চারপাশে। তারপর তারা বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। গ্রামবাসী এ সময় যে যেদিকে পেরেছেন সেদিকে পালিয়ে ছুটেছেন। তার ভাষায়, আমরা জানতাম না, কোথায় গেলে জীবন নিরাপদ হবে। স্থানীয় মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, ওই দুটি গ্রামের ১৬৬টি বাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করেছে দু’জন পুরুষকে। রাখাইন ভিত্তিক মিডিয়া বিষয়ক সংগঠন ডেভেলপমেন্ট মিডিয়া গ্রুপের মতে, এসব গ্রামের প্রায় ৮ হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। তবে এসব বক্তব্য নিরপেক্ষভাবে নিশ্চিত হতে পারে নি আল-জাজিরা। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মিয়ানমারও এর মোকাবিলা করছে। কিন্তু এই মহামারিকালে রাখাইনের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ শুধু এই মহামারিই মোকাবিলা করছেন এমন নয়। সেখানে শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও জাতিগত সশস্ত্র গ্রুপ আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে চলছে তীব্র লড়াই। সেই লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে জীবন নাভিশ্বাস রাখাইনদের। ৩রা রাতের সহিংসতার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করছেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু সেনামুখপাত্র এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা পরেরদিনই সংবাদ সম্মেলন করে উল্টো দায় চাপিয়েছে আরাকান আর্মির ওপর। তারা বলেছে, আরাকান আর্মিই সেনাবাহিনীর যানে হামলা করেছে। উল্লেখ্য, মিয়ানমারে জাতিগত বহু সশস্ত্র গ্রুপ আছে। তার মধ্যে অন্যতম রাখাইনের আরাকান আর্মি। তারা রাখাইনে অধিকতর স্বাধীনতা চায়। তারা বেশির ভাগ সমর্থন পায় জাতিগত রাখাইনদের পক্ষ থেকে। আরাকান আর্মির সঙ্গে সেনাবাহিনীর লড়াই শুরু হয় ২০১৮ সালের শেষের দিকে। রাখাইন এথনিকস কংগ্রেসের মতে, ওই সংঘাতে কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তারা চলে গেছেন পার্শ্ববর্তী চিন রাজ্যে।

হতাশাজনক ইতিহাসের এই রাজ্যে সহিংসতা, লড়াই এখন বিশ্বজোড়া পরিচিতি পেয়েছে। রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার জন্য ২০১৪ সালে জাতিগত দিক বিবেচনায় যে শুমারি করা হয়েছিল, তার ফল কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। রাখাইন হলো বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রাজ্য। তাদেরকেই ওই রাজ্যে সবচেয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে বেশির ভাগ মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সেখানে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু তারা ধারাবাহিক বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়ে আসছে। তাদেরকে দেয়া হয়নি নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকার। ২০১২ সালের জাতিগত সহিংসতায় এক লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইনের রাজধানী সিতওয়ের কাছে একটি ক্যাম্পে অবস্থান করছেন গাদাগাদি করে। এর ৫ বছর পরে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকারে পরিণত হয় রোহিঙ্গারা। তাদের নৃশংসতার কারণে কমপক্ষে ৭ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের তদন্তকারীরা বলেছেন, জাতিনিধনের উদ্দেশ্যেরোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ওই হামলা চালানো হয়েছে। মিয়ানমারে প্রথম স্থানীয়ভাবে করোনা আক্রান্তের তথ্য শনাক্ত করতে পারে ১৬ই আগস্টে সিতওয়েতে। ওই সময়ে সেখানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪ শয়ের কম। রাখাইনে ২০ জনের কম। ১৩ই সেপ্টেম্বরেরম মধ্যে রাখাইনে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৩৫। এখানকার ১৭টি শহরেই দেখা দেয় করোনা সংক্রমণ। ২৬ শে আগস্ট থেকে রাখাইনজুড়ে দেয়া হয় আংশিক লকডাউন। রাষ্ট্রের কাউন্সেলর অং সান সুচি আহবান জানান এর বিরুদ্ধে লড়াই করার। কার্যকর সাড়া দিতে পর্যপ্ত খাদ্য ও আর্থিক প্রয়োজনীয় সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কিন্তু সরকার রাখাইন ও চিন রাজ্যের আটটি শহরে বন্ধ করে রাখে থ্রিজি এবং ফোরজি নেটওয়ার্ক। নিরাপত্তার অজুহাতে এমনটা করে তারা। এসব নিয়ে স্বাস্থ্য ও স্পোর্টস বিষয়ক মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে আল জাজিরা। কিন্তু এর কোনো উত্তর পান নি সাংবাদিকরা। আল-জাজিরা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন