বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

‘নতুন’ মধ্যপ্রাচ্য?

ইসরাইলের সাথে দুই আরব রাষ্ট্রের চুক্তি

এপি | প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

ইসরাইল মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসের একটি অনুষ্ঠানে দু’টি উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রের সাথে ঐতিহাসিক ক‚টনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে ‘মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভোর’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি তার পুনর্নির্বাচনী প্রচার অভিযানে শীর্ষ কৃতিত্ব হিসেবে নিজেকে আন্তর্জাতিক শান্তিকামী হিসাবে ঘোষণা করবেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সাথে ইরানের পূর্ব বিরোধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিগুলো ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের পাতাকে স্বাভাবিক করায় আনুষ্ঠানিক রূপ দেয়। কিন্তু এসব চুক্তি ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলমান সঙ্ঘাতের সমাধান দেয় না। ফিলিস্তিনিরা সহযোগী আরবদের কাছ থেকে এসব চুক্তিকে তাদের পিঠে ছুরিকাঘাত এবং একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য তাদের বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে দেখে। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও একটি উৎসব পরিবেশে চুক্তি স্বাক্ষর স্বচক্ষে দেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কয়েকশো আমিরাতি সূর্যস্নাত দক্ষিণ লনে জড়ো হয়েছিলেন। অংশগ্রহণকারীরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেননি এবং বেশিরভাগ অতিথি মাস্কও পরেননি।

ট্রাম্প দক্ষিণ লনের বারান্দা থেকে বলেন, ‘ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনে আমরা আজ বিকেলে এখানে এসেছি। দশকের পর দশক বিভাজন ও সঙ্ঘাতের পর আমরা একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের উদয়কে নিশ্চিত করেছি’। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, দিনটি ইতিহাসের মূল বিষয়। এটি শান্তির এক নতুন ভোরের সূচনা করেছে। নেতানিয়াহু বা ট্রাম্প উভয়ই তাদের মন্তব্যে ফিলিস্তিনিদের কথা উল্লেখ করেননি, তবে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা উভয়েই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বের কথা বলেছেন। আবুধাবির শক্তিশালী যুবরাজের ভাই শেখ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এমনকি নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন আমিরাতী স্বীকৃতির বিনিময়ে ফিলিস্তিনিদের পশ্চিম তীরের জমি ‘জবরদখল বন্ধ’ করার জন্য। নেতানিয়াহু অবশ্য জোর দিয়ে বলেন যে, ইসরাইল কেবল পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা স্থগিত করেছে।

আল নাহিয়ান বলেছেন, ‘আজ আমরা ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রে পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছি, এমন একটি পরিবর্তন যা বিশ্বজুড়ে আশা-প্রেরণা দেবে’। বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল-লাতিফ আল-জায়ানী বলেছেন, বাহরাইন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে রয়েছে। আজ একটি সত্যই ঐতিহাসিক উপলক্ষ’-তিনি বলেন। ‘আশা এবং সুযোগের একটি মুহূর্ত’। তবে গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি প্রতিবাদীরা সম্ভবত এ অনুষ্ঠানের সাথে মিল রেখে ইসরাইলে দুটি রকেট নিক্ষেপ করে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, রকেটগুলো গাজা থেকে নিক্ষেপ করা হয় এবং একটি বিমানবাহিনী প্রতিরোধ করে। দিনের শুরুতে ফিলিস্তিনি কর্মীরা পশ্চিম তীরে এবং গাজায় ছোট ছোট বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, যেখানে তারা ট্রাম্প, নেতানিয়াহু এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন নেতাদের ছবি পদদলিত করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়।

ইসরাইল এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে, এসব চুক্তি এ অঞ্চলের একটি বড় পরিবর্তন হতে পারে। অন্যসব আরব দেশ, বিশেষত সউদী আরবের উচিত এ নীতি অনুসরণ করা। এটি ইরান, সিরিয়া এবং লেবাননের জন্য প্রভাব ফেলতে পারে। এর আগে ইসরাইল কেবল মিসর ও জর্দানের সাথে শান্তিচুক্তি করে। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবার কাছাকাছি বলে বিশ্বাস করা অন্যান্য আরব দেশের মধ্যে রয়েছে ওমান, সুদান এবং মরক্কো।

ট্রাম্প অনুষ্ঠানের আগে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা প্রায় পাঁচটি পৃথক দেশ নিয়ে রাস্তায় নামছি। অন্যদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিশ্লেষক ও প্রাক্তন কর্মকর্তা চুক্তিগুলোর প্রভাব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ইসরাইল, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পাশাপাশি বিশ্বের তিনটি প্রধান একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুসারীরা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নামে একটি নথি সই করেছে। ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ এবং ইসরাইল এবং বাহরাইন স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ক‚টনীতিক আদর্শ হিসাবে আরও বিস্তারিত আনুষ্ঠানিক চুক্তির সংক্ষিপ্ত রূপ হয়ে পড়ে। দু’টি দলিলই ক‚টনীতি, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক শান্তির অগ্রগতির প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সাধারণ বিবৃতি দিয়ে তৈরি হয়েছিল। ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে চুক্তির মধ্যে সর্বাধিক বিস্তারিত ছিল। দেশগুলো অর্থ, বাণিজ্য, বিমান চালনা, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, স্বাস্থ্য, কৃষি ও পানিসহ পারস্পরিক স্বার্থের ১৫টি ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুমোদনে সম্মত হয়েছিল।

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নেতারা একটি দীর্ঘ টেবিলে বসেছিলেন, যেখানে প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুমান একবার তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে সাপ্তাহিক মধ্যাহ্নভোজ সারেন। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত স¤প্রসারণ রোধে ট্রুমান মতবাদ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপে কোটি কোটি অর্থনৈতিক সহায়তা প্রেরণের মার্শাল পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা এ টেবিলে উপস্থাপিত হয়েছিল।

লাইভ মিউজিক এবং পতাকাসহ মঞ্চের কারুকাজের উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের পূর্ব চুক্তিগুলো বাতিল করা। ট্রাম্পের রাজনৈতিক সমর্থকরা নির্বাচনের দিনক্ষণ এগিয়ে আসার মাত্র সাত সপ্তাহ আগে রাজনীতিবিদ হিসাবে তার অবস্থানকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাস, জাতিগত ইস্যু এবং অর্থনীতির প্রভাবে এ প্রচারণায় বৈদেশিক নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেনি।

রিপাবলিকানদের পাশাপাশি কিছু ডেমোক্র্যাট এ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ এক অগ্রগতি এমন সময়ে যখন তাদের নেতা, হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি প্রেসিডেন্টের সাথে খুব কমই কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেনসহ অনেক ডেমোক্র্যাট এ চুক্তিকে সমর্থন করেন।

‘এটা দেখে ভাল লাগবে যে, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যরা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এমনকি মিত্র হিসাবে এটি স্বাগত জানিয়েছে’। বুধবার রাতে জারি করা এক বিবৃতিতে বাইডেন জানিয়েছেন এ কথা। বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন এ পদক্ষেপগুলো অব্যাহত রাখবে, অন্যান্য জাতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকবে এবং দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের এবং এ স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ অঞ্চলের অগ্রগতির দিকে এ ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে কাজে লাগাতে কাজ করবে’।
তবে চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে এমনকি ইসরাইলেও, যেখানে এসব চুক্তিকে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের কাছে অত্যাধুনিক মার্কিন অস্ত্র বিক্রি করার পাশাপাশি সেই অঞ্চলে ইসরাইলের সামরিক প্রাধান্য বিপর্যয়ে পড়তে পারে।

ট্রাম্প বলেছেন যে, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে সামরিক বিমান বিক্রি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পেলোসিও এ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন, তবে তিনি বলেছেন, বিশেষত ট্রাম্প প্রশাসনের সংযুক্ত আরব আমিরাতকে মার্কিন-তৈরি এফ-৩৫ বিক্রি এবং পশ্চিম তীরে ইসরাইলের প্রবেশে স্থিতাবস্থা বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের মতবিরোধ এবং সমালোচনামূলক জনমতকে দমন করার ইতিহাস রয়েছে, তবে ইঙ্গিত রয়েছে যে, চুক্তিগুলো ইসরাইলে যতটা জনপ্রিয় আরব আমিরাত বা বাহরাইনে ততটা জনপ্রিয় নয়। নেতানিয়াহুর সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য কোনও দেশই তার রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারকে প্রেরণ করেনি।

বাহরাইনের বৃহত্তম শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ বিরোধী দল আল-ওয়াফাক জানিয়েছে, সেখানকার সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে এ চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

ট্রাম্পের জামাতা এবং সিনিয়র উপদেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রদূত অ্যাভি বারকোভিটসের নেতৃত্বে কয়েক মাসের জটিল কূটনীতির পর ১৩ আগস্ট ইসরাইল-সংযুক্ত আরব আমিরাত চুক্তি ঘোষিত হয়। এরপরে দেশগুলির মধ্যে প্রথম সরাসরি বাণিজ্যিক বিমান এবং তারপরে ১১ সেপ্টেম্বর বাহরাইন-ইসরাইল চুক্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
Jubaida Mou ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৩:২৯ এএম says : 0
ইনশাআল্লাহ আল্লাহ্ সুবাহনুতালা মুসলিমদের সঠিক পথ দেখাবেন।
Total Reply(0)
Bhuiyan Shariful Islam ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৩:২৯ এএম says : 0
চমৎকার বিশ্লেষণ বটে।
Total Reply(0)
আবদুল হাকিম রন্জু ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৩:৩০ এএম says : 0
খুব সুন্দর বিশ্লেষন তবে আমার চাওয়া হচ্ছে ইসরাইল ও তার মিত্ররা নিপাত যাক যা এ লেখায় পাওয়া গেল না। কেননা ইসরাইল খুব কৌশলে ছোট দেশ হয়েও কিভাবে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ করছে । তবে প্রতিপক্ষ সজাগ তার পতন বা কৌশল অকার্যকর হতে দেরি হবে না।
Total Reply(0)
Munshat Chowdhury ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৩:৩০ এএম says : 0
চমৎকার লেখা। তবে চীন রাশা যে খুব বিশ্বাসযোগ্য কিছু হবে মুসলমানদের জন্য, সেও ভাবি না। রাশা সবসময়ই প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ইসরায়েলের স্বার্থই রক্ষা করেছে। আরেকটা জিনিস মনে করিয়ে দেই। ইউরোপ কখনোই চায় না, ইহুদীগুলো তাদের দেশে আবার ফেরত যাক। আর ইউরোপীয় ইহুদীদের বিরাট একটা অংশই হচ্ছে রাশা ও পুর্ব ইউরোপ হতে আগত।
Total Reply(0)
রিপন ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১০:০১ এএম says : 0
ইসরাইলের সাথে যারা চুক্তি করেছে তাদের ধ্বংস অনিবার্য
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন