বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ফিকে হচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন

দফায় দফায় বন্যা কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, প্রথম তিন দফা বন্যায় ক্ষতি ১ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমির ফসল যার আর্থিক পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

দফায় দফায় বন্যার ফলে দিশেহারা কৃষক। বার বার চেষ্টা করেও তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। এ নিয়ে চতুর্থ দফা বন্যায় তলিয়েছে ফসলি জমি। একের পর এক বন্যায় ফসল হারিয়ে কৃষক এখন প্রায় সর্বস্বান্ত। চলতি মৌসুমে ২৬ জুন প্রথম দফায় বন্যা শুরু হয়। ১০ জুলাই দ্বিতীয় দফা, ১৯ জুলাই তৃতীয় দফা এবং ১৮ অগাস্ট উপক‚লীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়। আগস্ট মাসে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের কৃষক তাদের জেগে ওঠা জমিতে, ধান, মাসকলাই ও শাকসবজি চাষ করেন। তবে গত ৩/৪ দিন ধরে ভারতের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় আবার তলিয়ে গেছে তাদের ক্ষেতের ফসল। সেই সাথে উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের সব স্বপ্ন আশা আবার শেষ হয়ে গেল।

ভারতের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে যমুনা, ধরলা, তিস্তাসহ বিভিন্ন নদীর পানি বেড়ে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধায় বন্যা দেখা দিয়েছে। চতুর্থ দফা বন্যায় এ অঞ্চলের প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর আবাদি ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। যমুনার পানি বেড়ে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে প্রায় একশ’ হেক্টর জমির রোপা আমনসহ উঠতি ফসল তলিয়ে গেছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় যমুনার পানি বৃদ্ধি পেয়ে তলিয়ে গেছে সদ্য রোপণকরা আমন ধানের ক্ষেত। এ ছাড়া নেত্রকোনায় গত কয়েক দিনের অতিবর্ষণে তলিয়ে গেছে একহাজার হেক্টর জমির আমন ধান। সব মিলিয়ে আশ্বিনের এ বন্যায় আবার ফিকে হয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন।

গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে কুড়িগ্রামে সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। টানা চতুর্থ দফা বন্যায় জেলার প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর আবাদি ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। এরমধ্যে আমন ১৮৪০ হেক্টর, মাসকালাই ১২৭ হেক্টর, শাকসবজি ১২৭ হেক্টর ও বাদাম ১০ হেক্টর। লালমনিরহাটে, তিস্তা ও ধরলার তীরবর্তী নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলসহ চরাঞ্চলগুলো। এতে প্রায় সাতশ’ হেক্টর জমির বিভিন্ন জাতের ফসল তলিয়ে গেছে। গেল বন্যার ধকল না কাটতে ফের বন্যায় পড়ে তিস্তা ও ধরলার তীরবর্তী কৃষকরা দিশেহারা। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে বন্যার ধকল কেটে উঠতে না উঠতেই তীব্র আকারে দেখা দিয়েছে তিস্তার ভাঙন। বৃষ্টির পানি, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে এবং তিস্তার অব্যাহত ভাঙনে উঠতি ফসলসহ বসত বাড়ি বিলীন হচ্ছে নদীগর্ভে। টানা ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের পরিবারগুলো।

ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় যমুনা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শহড়াবাড়ি ঘাট পয়েন্টে ৫৬ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নদীর কূল উপচে চরের জমি প্লাবিত হয়েছে। সদ্য রোপা আমনের কয়েক শত একর জমি পানিতে তলিয়ে গেছে।
সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলায় দ্রুত গতিতে যমুনার পানি বাড়তে থাকায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে তলিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। দফায় দফায় বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের দেয়া কৃষি প্রণোদনার ধানের চারাও তলিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কাজিপুরে যমুনা অধ্যুষিত তেকানি, চর গিরিশ, নিশ্চিন্তপুর, মাইজবাড়ী, শুভগাছা, খাস রাজবাড়ী ও নাটুয়ারপাড়া ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলগুলোতে পানি ঢুকে পড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৮৯ হেক্টর জমির রোপা আমনসহ উঠতি ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। আশঙ্কাজনকহারে পানি বাড়তে থাকায় আবারও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে কৃষক। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে চরাঞ্চলের প্রায় ৮০ ভাগ রোপা আমন ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অতিবর্ষণ ও খালে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণে নেত্রকোনা সদর উপজেলার মৌগাতী ইউনিয়নের প্রায় ১০টি গ্রামের কমপক্ষে একহাজার হেক্টর জমির আমন ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। খালের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে পুকুর তৈরি করে মাছ চাষ করায় জমিতে থাকছে অতিরিক্ত পানি। নেত্রকোনা জেলায় অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কয়েক দফা বন্যার কারণে এবার এমনিতেই কয়েকটি উপজেলায় কৃষকদের আমন আবাদ বিলম্ব হয়। বন্যার পানি কিছু কমলে বিলম্বে চাষাবাদ করে আমন জমিতে চড়া দামে ধানের চারা কিনে তা রোপণ করে আবাদ শুরু করেন কৃষকরা। সেই রোপা আমনের ক্ষেত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও ভারতের ঢলে তলিয়ে গেছে।

বাংলাদেশ কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে ১১ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, দেশের ৩৩ জেলায় বন্যায় প্রায় ১৩ লাখ বিঘা জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ফসলের মধ্যে রয়েছে ধান, আমন বীজতলা, সবজি, ভুট্টা, তিল, মরিচ, চীনা বাদাম, পান, পাট, কলা, লেবু ও আখ। তবে বন্যাকবলিত এই ৩৩ জেলায় অক্ষত আছে এক কোটি ৩১ লাখ ১৫ হাজার ২৮০ বিঘা জমির ফসল।

অপর দিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানানো হয়, বন্যায় প্রায় একমাসে দেশের ৩১ জেলায় সাড়ে ছয় লাখের বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের এ ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত ৩১ জেলার প্রায় ১ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে নষ্ট হয়েছে ৩ লাখ ২৮ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের শস্য। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আউশের। ৫০ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আউশের যে ক্ষতি হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য প্রায় ২৫২ কোটি টাকা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৯৭ হাজার ১৮৪। এ ছাড়া ৯৫ হাজার ৫৭০ জন কৃষকের ২৫৯ কোটি ৭০ লাখ টাকার পাট ও ৮৮ হাজার ৪০৮ জন কৃষকের ১৫৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকার বোনা আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় আমন বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৬ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমির। এতে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৯৮৬ জন কৃষকের মোট ক্ষতির পরিমাণ ১২৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া গ্রীষ্মকালীন সবজিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় প্রায় এক লাখ কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ ২৯০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা ও বন্যায় দুই দফায় কৃষকের ক্ষতির পরিমাণ ৫৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।

কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে আমরা কৃষকের পাশে থেকে বাংলাদেশের কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে বদ্ধপরিকর। আমরা বন্যার ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, তাতে ক্ষয়ক্ষতি বহুলাংশে কাটিয়ে উঠা যাবে এবং এই ক্ষয়ক্ষতি আমাদের খাদ্য উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়বে না বলে আশা করি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন