করোনা পরিস্থিতি বিপাকে ফেলেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। একদিকে প্রাণঘাতি এই ভাইরাসের কারণে পিছিয়ে গেছে চলতি বছরের এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা। ফলে শিক্ষার্থী সঙ্কট দেখা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। অন্যদিকে সার্বিক পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও টিউশন ফি নিয়মিত পাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। শিক্ষার্থী সঙ্কট ও আয় কমলেও থেমে নেই ভবন ভাড়া, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। ফলে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস রয়েছে এবং প্রথম সারিতে রয়েছে তারা কিছুটা স্বস্তিত্বে থাকলেও বিপদে পড়েছে তুলনামূলক নতুন ও ভাড়া ভবনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
ব্যয়ভার বহন করতে না পারায় ইতোমধ্যে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমানো হয়েছে লোকবল। ব্যয় নির্বাহ করতে অনুমোদনের সময় জমা দেয়া জামানাতের অর্থ চেয়েও আবেদন করেছে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক সঙ্কটে পরে টিকে থাকার লড়াই করলেও এরই মধ্যে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে নতুন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ৫০টির মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের অপেক্ষায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন করেছেন সরকার দলীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা।
বর্তমানে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৭টি। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে ৯৬টির। করোনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কারণ শিক্ষার্থী থাকুক আর না-ই থাকুক, তাদের মাস শেষে বড় অঙ্কের ভবন ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা ধরনের সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের অনেকেই নিয়মিত টিউশন ফি পরিশোধ করছে না। ফলে যা আয় হয়, তা দিয়ে ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই স্বল্পসংখ্যক জনবল কমালেও রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী ও ধানমন্ডিতে ক্যাম্পাস থাকা একটি বিশ্ববিদ্যালয় বড় ধরনের জনবল কমিয়েছে।
যেখানে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে সেখানে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষাবিদরা। প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো কোনভাবেই ঠিক হবে না বলে মনে করেন তারা। করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের শিক্ষাখাত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, ক্লাস-পরীক্ষা কোনকিছুই নিতে পারছে না সরকার। এমনকি সব প্রস্তুতি থাকার পরও করোনা নিয়ন্ত্রণে না আসায় এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষাও পিছিয়ে গেছে। এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও কবে হবে এই পরীক্ষা তা এখনো অনিশ্চিত। এদিকে প্রতিবছর এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হয়ে থাকে। কিন্তু এবছর এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় গত জুলাইয়ে সামার সেমিস্টারেই শিক্ষার্থী সঙ্কটে পড়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে নর্থ-সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, ব্র্যাক, আহসান উল্লাহ, ইউনাইটেড, ইন্ডিপেন্ডেন্টসহ প্রথম সারির কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিরা শিক্ষার্থী সঙ্কটে পড়েছে। আগের সেমিস্টারে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল তার অর্ধেকও এবার পাচ্ছে না তারা। জানা যায়, প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যায়গুলো মোট আসনের মধ্যে গড়ে ৬০-৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পেরেছে। এর মধ্যে ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও ব্র্যাক আসনের কোটা পূরণ হয়েছে। নর্থ-সাউথ ১৩শ, ইউনাইটেড পেয়েছে সাড়ে ৪শ’র মতো শিক্ষার্থী পেয়েছে। আর মধ্যসারির ৫০ শতাংশও পায়নি। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি পেয়েছে ৫শ’ আর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি পেয়েছে ১৬২ জন শিক্ষার্থী। স্টেট, প্রাইম, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল, ইস্টার্ন, আইইউবিএটি’র মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী খরায় ভুগছে। এছাড়া নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১০ থেকে ২০জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পেরেছে। কোন কোনটিতে এখনো শিক্ষার্থীই পায়নি।
নতুন সেমিস্টারে শতাধিক শিক্ষার্থীও হয়নি মধ্যসারির এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩০টিরও বেশি। আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা আরও খারাপ। টিউশন ফি কমিয়ে, নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার জন্য অফার দিয়েও শিক্ষার্থী পায়নি এসব বিশ্ববিদ্যালয়। ফল ও স্প্রিং দুই সেমিস্টারে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি (আইএসইউ) টিউশন ফির ওপর ৪০ শতাংশ ছাড় ও ছাত্রীদের জন্য ৬০ শতাংশ ছাড় দিয়েও তেমন সাড়া পায়নি। ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫০।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ডিআইইউ) গত বছরের সামার ও ফল দুই সেমিস্টারে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি। এবার এখন ডিআইইউতে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে আড়াইশর কিছু বেশি।
এরই মধ্যে সেপ্টেম্বর অক্টোবরে নতুন সেমিস্টার শুরু হওয়ার কথা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। যেখানে আগের সেমিস্টারেই শিক্ষার্থী সঙ্কটে ভুগতে হয়েছে, সেখানে এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়াতেই এই সেমিস্টার ফাঁকা যাবে বলে জানিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভিসি প্রফেসর ড. চৌধুরী মফিজুর রহমান বলেন, নতুন যে সেমিস্টার শুরু হয়েছে সেটিতেই শিক্ষার্থী অনেক কমে গেছে। এইচএসসি পরীক্ষা দেরিতে হওয়ায় সামনের সেমিস্টার ফাঁকা যাবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়বে। তিনি বলেন, পুরাতন ও যাদের নিজস্ব ক্যাম্পাস আছে তারা হয়তো কোন মতে চলতে পারবে। কিন্তু যারা নতুন, ভবন ভাড়া দিতে হয় তাদের অবস্থা আরও করুন। অনেকেই ভাড়া ও বেতন দিতে পারছে না। সেক্ষেত্রে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো বন্ধও হয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে করোনার কারণে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা নিয়মিত তাদের টিউশন ফি পরিশোধ করতে পারছে না। এতে আর্থিক সঙ্কট বেড়েছে তাদের। ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভবন ভাড়া, শিক্ষক-কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের সময় জমা দেয়া জামানতের অর্থ তুলে ফেলতে ইউজিসির কাছে আবেদন করেছে।
জানা যায়, ঢাকা মহানগরীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেতে পাঁচ কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করতে হয়। আর জেলা পর্যায়ে তিন কোটি এবং মফস্বল বা উপজেলা পর্যায়ে দেড় কোটি টাকা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এসোসিয়েশন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্রে জানা যায়, আর্থিক সঙ্কটের কারণে এই ডিপোজিটের টাকা ভাঙতে চাইছে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। এই সংখ্যা অন্তত: ২৫টি হবে বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি সূত্রে জানা যায়। ইতোমধ্যে কয়েকটি ইউজিসিতে আবেদন করেছে, আরও কয়েকটি আবেদন করার অপেক্ষায়। এর মধ্যে রাজধানীর অন্তত: ১৫টি এবং ঢাকার বাইরের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় জামানতের টাকা ভাঙার জন্য ইউজিসিতে যোগাযোগ করছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে অনেক প্রতিষ্ঠান জনবল কমাচ্ছে। আবার কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমাচ্ছে।
বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, আমরা নতুন প্রায় ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছি। সেখানে সামার সেমিস্টারে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে। এখন সমস্যায় পড়ে এফডিআর ভাঙার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ব্যাপারটি ইউজিসি বা মন্ত্রণালয়ের ভেবে দেখা উচিত। তবে আমরা এই সংকটময় মুহূর্তে সরকারের কাছে প্রণোদনা হিসেবে সুদবিহীন ঋণ চেয়েছিলাম; কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। আমরা যদি ঋণ পাই, তাহলে কারো এফডিআর ভাঙার প্রয়োজন পড়বে না।
এ ব্যাপারে ইউজিসির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, এফডিআরের টাকা তুলে নেওয়ার জন্য দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয় যোগাযোগ করেছে। এই ধরনের কোনো সুযোগ আছে কি না আমরা দেখছি। আইনি দিক পর্যালোচনা করে এরপর তা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবো। #
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন