শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

বাঙালি জাতির আদি পুরুষ নুহ নবীর প্রপৌত্র বঙ

প্রকাশের সময় : ১১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাহমুদ ইউসুফ
বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস এবং আদিম জনগোষ্ঠীর ধারণা ধূ¤্রজালে আচ্ছন্ন। রয়েছে নানাবিধ মত অভিমত। পক্ষ বিপক্ষের উল্টা-পাল্টা বয়ানে পাঠকরা বিভ্রান্ত। নানা মুনির নানা মত। ইতিহাসবেত্তা ও গবেষকদের সত্য-অসত্যের বর্ণনায় সাধারণ শিক্ষিতরা তথ্যবিভ্রাটের শিকার। অধিকাংশের বর্ণনাই উদ্ভট, মিথ্যা, কল্পনার রঙে রঙিন। বিভিন্ন ধরনের মিথও যুক্ত এর সাথে। কেউ বা আবার সত্যের সন্ধান পেয়েও আদর্শিক কারণে তা গোপন করেছেন বা অস্বীকার করেছেন। আবার কেউ সত্যের কাছাকাছি পৌঁছেও সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে সেখান থেকে ছিটকে পড়েছেন। এ জন্যই বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির পাঠ্যভুক্ত হতে পারেনি। তাই প্রাগৈতিহাসিককালের সঠিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত এদেশের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা; সামগ্রিকভাবে সকল জনগোষ্ঠী। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা এ ভূখ-ের প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর আবির্ভাব নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব। আমরা মনে করি বাংলার প্রাচীন অধিবাসী সম্পর্কে পরিবেশিত এসব তথ্য শতভাগ সত্যি, সঠিক এবং বস্তুনিষ্ঠ। কারণ এ পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্ভুল জ্ঞান হলো অহি। মহাজ্ঞানী হতে হলে তাকে অবশ্যই অহির শরণাপন্ন হতে হবে। অহির ভিত্তিই এ নিবন্ধের উৎস।
বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ গোলাম হোসায়ন জইদপুরি। তিনি বাংলার ইতিহাস নিয়ে ১৭৬৬-১৭৮৮ সালে রচনা করেন ফারসি গ্রন্থ রিয়াজ উস সালাতিন। এ পুস্তকে তিনি হযরত নুহ আ. এর সাথে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা সম্পর্কের বিষয় উত্থাপন করেছেন। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ ২৮)। তিনি লিখেছেন, হযরত নুহ আ. এর পুত্র হামের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিন্দ হিন্দুস্তানে আসার দরুণ এই অঞ্চলের নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয়। সিন্ধু জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সাথে এসে সিন্ধ দেশে বসতি স্থাপন করায় এই অঞ্চলের নাম তাঁরই নামানুসারে সিন্ধু রাখা হয়। হিন্দের দ্বিতীয় পুত্র বং (বঙ্গ)-এর সন্তানেরা বাংলায় উপনিবেশ স্থাপন করেন। আদিতে বাংলার নাম ছিল বঙ। (সূত্র : গোলাম হোসায়ন সলীম : বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতীনের বঙ্গানুবাদ), আকবরউদ্দীন অনূদিত, অবসর প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৪)।
বিস্ময়কর এবং রহস্যজনক হলেও তথ্যটি বাস্তব এবং সত্য। কারণ নবি রসুলদের বংশধররাই দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বসতি স্থাপন করেন। প্রাগৈতিকহাসিককাল বা প্রাচীনকাল উভয় সময়কালেই এর সত্যতা বহন করে। অহির ধারক-বাহকরাই পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার আদিবাসী। বর্তমান পৃথিবীতে যত মানুষ আছে সবারই পূর্বসূরী নবী-রসুলবৃন্দ। সে হিসেবে নুহ নবী ও তাঁর বংশধরদের সাথে বাংলাদেশের আদি ইতিহাস সংশ্লিষ্ট। এ বিষয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. মোহাম্মদ হাননান এর বয়ান প্রাণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, বাঙালির ইতিহাস অতি প্রাচীন। আনুমানিক ১০ হাজার বছর পূর্ব থেকে বাঙালি জাতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। আরেকটি সূত্র মতে বাঙালি জাতি এসেছে নুহ আ. এর বংশ থেকেই। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ ৬৪৪, ৩১)। অন্যত্র তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাস নুহ আ. এর সময় থেকেই শুরু এবং এ থেকেই অনুমান করা যায় এর ইতিহাসের প্রাচীনতার বিষয়টি। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ ৬৪৪, ৩০)। খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, আপন আপন বংশ ও জাতি অনুসারে ইহার নুহের সন্তানদের গোষ্ঠী; এবং জলপ্লাবনের পরে ইহাদের হইতে উৎপন্ন নানা জাতি পৃথিবীতে বিভক্ত হইল। (সূত্র : পবিত্র বাইবেল: পুরাতন ও নতুন নিয়ম, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা ১৯৮১, পৃ ১২-১৩)।
আদম আ.-এর মাধ্যমে জগতে মানব বসতি শুরু। তিনিই মানবজাতির জনক। তাঁর হাতেই সভ্যতার অভিযাত্রা। তাঁর আগমনে এ পৃথিবী ধন্য। বর্তমান দুনিয়ার সব মানুষই তাঁর বংশধর ও সন্তান-সন্তুতি। তিনি শুধু সাধারণ কোনো ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহ প্রেরিত অহির নিশানবাহী পুরুষ। নবীদের পরম্পরায় আদম আ. যদিও সর্বপ্রথম নবি, কিন্তু তাঁর আমলে ইমানের সাথে কুফর ও গোমরাহির মোকাবেলা ছিলো না। তাঁর শরিয়াতের অধিকাংশ বিধানই পৃথিবী আবাদকরণ ও মানবীয় প্রয়োজনাদির সাথে সম্পৃক্ত। কুফর ও কাফিরদের কোথাও অস্তিত্ব ছিল না। কুফর ও শিরকের সাথে ইমানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নুহের আমল থেকেই শুরু হয়। রিসালাত ও শরিয়াতের দিক দিয়ে তিনিই জগতের প্রথম রসুল। এছাড়া তুফানে সমগ্র পৃথিবী নিমজ্জিত হওয়ার পর যারা প্রাণে বেঁচে ছিলেন, তারা ছিলো হযরত নুহ আ. ও তাঁর নৌকাস্থিত সঙ্গি-সাথী। তাদের দ্বারাই পৃথিবী নতুনভাবে আবাদ হয়। এ কারণেই তাঁকে, ‘ছোটো আদম’ বলা হয়। (সূত্র : মুফতি মুহাম্মাদ শফি: তাফসিরে মারেফুল কুরআন (মাওলানা মুহিউদ্দিন খান কর্তৃক তরযমাকৃত), খাদেমুল হারামাইন বাদশাহ ফাহাদ কুরআন মুদ্রণ প্রকল্প, সৌদি আরব, পৃ ৪৫২)।
এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ও গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান আরও লিখেছেন, হযরত আদম আ. থেকে আমাদের এই মানব জাতির শুরু। কিন্তু নুহের সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে এক মহাপ্লাবন ঘটে। এই মহাপ্লাবনে দুনিয়ার সকল কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। কেউ জীবিত ছিল না। শুধু নুহের নৌকায় আরোহণ করেছিলেন ৮০ জন নুহের ভক্ত; এই ৮০ জন থেকেই মানব জাতির আবার নতুন যাত্রা।
এই নতুন যাত্রায় জাতিরও সম্পর্ক ছিল। বেঁচে যাওয়া ৮০ জনের মধ্যে ছিলেন নুহের এক পুত্র; নাম তাঁর ‘হাম’। নুহ তাঁর পুত্র হামকে বললেন, ‘তুমি মানব বসতি স্থাপনের জন্যে চলে যাও পৃথিবীর দক্ষিণ দিকে’। পিতার নির্দেশ পেয়ে হাম চলে এলেন আমাদের এশিয়া মহাদেশের কাছাকাছি। সেখানে এসে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিন্দকে পাঠালেন ভারতের দিকে। অনেকে মনে করেন, হামের পুত্র হিন্দের নাম অনুসারেই ভারতের নাম হয়েছে হিন্দুস্তান।
হিন্দের দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল ‘বঙ্গ’। এই ‘বঙ্গ’- এর সন্তানরাই বাঙালি বলে পরিচিতি লাভ করে। এই গল্প সত্যি হলে বলতে হবে বাঙালির আদি পুরুষ হচ্ছেন ‘বঙ্গ’। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হান্নান : দেশের নামটি বাংলাদেশ কে রেখেছে এই নাম, অনুপম প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ১৫-১৬)।
অতীতকাল থেকেই দেখা যায়, মুসলিমরা নামের সাথে বাঙাল বা বাঙালি শব্দ ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, লালবাগ কেল্লার পরিবিবির কবরের দক্ষিণ পাশে ফাঁকা জায়গায় একটি কবর আছে। নামফলকে লেখা মির্জা বাঙালির সমাধি। (সূত্র : মাসিক ইতিহাস আন্বেষা, ১৩বর্ষ, এপ্রিল ২০১৬, ফকিরাপুল ঢাকা, পৃ ২৬)। বর্তমানেও দেখা যাবে অনেক মুসলিমই নামের আগে বা পরে বাঙাল বা বাঙালি শব্দ ব্যবহার করেন। কিন্তু কোনো হিন্দু বা অমুসলিমকে এসব পরিভাষা ব্যবহার করতে দেখা যায় না। এর কারণ নুহের প্রপৌত্র বঙ ছিলেন মুসলিম এবং আল্লাহর একত্ববাদে বিশ^াসী। তার স্মৃতির জন্য হোক বা দেশ-জাতি প্রেম হোক মুসলিমরা নামের সাথে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, করছেন। অন্যদিকে অমুসলিমরা সচেতনভাবেই এসব শব্দ এড়িয়ে চলেছে। তাছাড়া আর্য হিন্দুদের আগমনের পূর্বে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান, কাল ও বস্তুর সুন্দর নাম ছিলো। কিন্তু আর্য হিন্দুরা এদেশ জয় করে তারা নাম বদলিয়ে দেয়। ইতিহাসবিদ মোহাম্মাদ আবদুল জব্বারের ভাষায়, আর্যগণ সকল ক্রিয়াকর্ম ও ব্যবহারিক জীবনে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে লাগল। তারা গ্রাম, নদী, বৃক্ষলতা ও কুলের পূর্বতন নাম পরিবর্তন করে তাদের ভাষায় নতুন নামকরণ করতে আরম্ভ করল। (সূত্র : মোঃ আবদুল জব্বার: বাংলাদেশের ইতিহাস (প্রাচীন যুগ), ঢাকা ১৯৭৭, পৃ ৩০; উদ্বৃতি: অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, বাংলার ইতিহাস (প্রাচীনকাল থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত), অধুনা প্রকাশন, ৩২/২-ক, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, ২য় সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০৬, পৃ ৩৩)।
বঙ ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের যে স্থানে এসে বসতি স্থাপন করে সেই স্থানের নাম তাঁরই নামানুসারে হয় বঙ্গদেশ অথবা বঙের সন্তানরাই বঙ্গাল বা বাঙ্গাল অথবা পরবর্তীকালে বাঙ্গালী, আরও পরে বাঙালি বলে খ্যাতি লাভ করে। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ ২৯)। অতএব সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় বঙই হলেন বাঙালি জাতির আদিম পুরুষ, আদি গুরু ও আদি জনক। বঙ থেকেই বাঙালি জাতির পয়দা বা উৎপত্তি। বঙ্গোপসাগরের নামকরণও এই বঙ থেকে। বঙই বাংলা ও বাংলাদেশের গোড়াপত্তন ঘটান। তাই বঙই বাঙালি জাতির স্থপতি, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ। বর্তমান বাঙালি ও বাংলাদেশিরা তাঁরই উত্তরসূরী।
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Shah Alam ২৬ আগস্ট, ২০২০, ৩:৫৭ এএম says : 0
মুগ্ধতা রেখে গেলাম ।
Total Reply(0)
গনতন্ত্র তালুকদার ২৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১১:২৫ পিএম says : 0
বাংলাদেশ আদিপুরুষের ইতিহাস জানতে চায়
Total Reply(0)
কবির ৯ অক্টোবর, ২০২১, ৯:৪৭ এএম says : 0
সঠিক তথ্য অনেকেই জানেনা।আমিও জানতাম না।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন