পেঁয়াজ নিয়ে ভারতের কানামাছি খেলা চলছে। বাংলাদেশ মশলা জাতীয় এ পণ্যটির জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল বুঝতে পেরে মোদি সরকার পেঁয়াজ রফতানি নিয়ে এমন নাটক করছে। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি সিদ্ধান্ত নেয় ‘আর নয় ভারতের পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীলতা’ তাহলে বিপাকে পড়ে যাবে ভারতের কৃষকরা। কারণ বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। বাকি পেঁয়াজের চাহিদা তুরস্কই মেটাতে পারে। এছাড়াও মিসর, মিয়ানমার, পাকিস্তান থেকে আমদানি করলেই ‘উচিত শিক্ষা’ পাবে ভারত। গরুতে বাংলাদেশ যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে কৃষকদের প্রণোদনা আর একটু সচেতন হলে পেঁয়াজেও সেটা সম্ভব।
জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পেঁয়াজ মিয়ানমার থেকে আসছে। তুরস্ক থেকে আসবে। এখন আর পেঁয়াজের দাম বাড়বে না। দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ ভালো আছে। ভারত হঠাৎ বন্ধ করায় বাজার অস্থির হলেও তা আবার ধীরে ধীরে কমেছে। এখন ভারত থেকে পেঁয়াজ আসুক আর না আসুক, বাজারে সমস্যা হবে না। মাটি উপযোগী কৃষি গবেষণা করে উন্নত জাত উদ্ভাবন করে পেঁয়াজে স্বাবলম্বী হওয়া যায়।
ভারত পেঁয়াজের রফতানি বন্ধ করার পর বিকল্প হিসেবে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজের চালান বাংলাদেশে পৌঁছেছে। তুরস্ক থেকেও পেঁয়াজ আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। তুরস্ক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে ১৫ হাজার টন পেঁয়াজ পাঠাতে আগ্রহী। বেসরকারিভাবে দেশটির ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে এসব পেঁয়াজ পাঠাবে। তুরস্কে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন থেকে এ প্রস্তাবনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ মিশন সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের চাহিদা মতো পেঁয়াজ সরবরাহে প্রস্তুত তুরস্ক। দেশটিতে কয়েক রকমের পেঁয়াজ রয়েছে। ২০১৯ সালেও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছে বাংলাদেশ। তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ কিনে ঢাকায় আনতে পরিবহন খরচসহ প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা পড়তে পারে বলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফরিদপুর, যশোর অঞ্চল ছাড়াও রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, লালমনিরহাট, বগুড়া, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, জয়পুরহাটে প্রচুর পেঁয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। গত বছর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করায় হঠাৎ করে পণ্যটির দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। দাম বেড়ে যাওয়ায় জেলাগুলোতে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়ে গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষকদের নানামুখী সহায়তা দেয়া হলে পেঁয়াজে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাবে।
এবার ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ থেকে ইলিশের চালান ভারতে পৌঁছে। ইলিশ পেয়েই বন্ধুত্বের প্রতিবাদ হিসেবে ভারত সীমান্তে পেঁয়াজের চালান বন্ধ করে দেয়। ফলে শত শত পেঁয়াজের ট্রাক আটকা পড়ে। ১৮ সেপ্টেম্বরের পর সীমান্তে আটক ট্রাকগুলো ছাড় দেয়া হলেও পরে আবার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়। আটকেপড়া ট্রাকগুলোতে আনা পেঁয়াজের মধ্যে এক চতুর্থাংশ পঁচে গেছে।
সূত্র জানায়, পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকার নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করা হচ্ছে। পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে ৩৬ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পেঁয়াজ আমদানীতে ৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। জানা যায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে পেঁয়াজ আমদানির ওপর ৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় দেশে পণ্যটির দাম বেড়ে যায়। ফলে পেঁয়াজ আমদানিকারকরা শুল্ক তুলে নেয়ার সুপারিশ করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে এনবিআরকে শুল্ক তুলে নেয়ার অনুরোধ করে ১৫ সেপ্টেম্বর পুনরায় পেঁয়াজের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করে এনবিআরকে চিঠি দেয়। অতঃপর অর্থমন্ত্রী শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
জানা গেছে, ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে প্রায় দেড় হাজার টন পেঁয়াজ আসে। একই সময়ে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজের চালান টেকনাফ স্থলবন্দরে পৌঁছে। পরের দিন সে পেঁয়াজ দ্রæত ছাড় করা হয়। এ সময় তুরস্ক থেকে আগের এলসি করা পেঁয়াজ এসেছে। চীন, মিসর, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা এক লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আসা প্রক্রিয়াধীন। এরই মধ্যে টিসিবি ৩০ টাকা কেজিতে খোলাবাজারে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করে। সংস্থাটি গতকাল ৩৬ টাকা কেজিতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ঘরে পেঁয়াজ পৌঁছে দেয়ার কর্মস‚চি চালু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পেঁয়াজের এলসি মার্জিন ন্যূনতম রাখার নির্দেশ দিয়েছে। বন্দরগুলোতে আমদানি পেঁয়াজ দ্রæত খালাসের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। দেশি পেঁয়াজের মোকাম ও বাজার পর্যায়ে কারসাজি রোধে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। এসব কারণে বাজারে দাম কমে এখন স্বাভাবিক হচ্ছে।
রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম কমেছে। আমদানি করা পেঁয়াজের দাম কমে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় নেমেছে। দেশি পেঁয়াজ ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা টিসিবি’র তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বাজারে খুচরায় গতকাল কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা কমে দেশি পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়। এর আগের দিন দেশি পেঁয়াজ ১০০ থেকে ১২০ টাকা ও আমদানি পেঁয়াজ ৯০ থেকে ১০০ টাকায় ওঠে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনী বলেন, ভারত নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে সীমান্তে আটকে পেঁয়াজ দেয়া শুরু করেছে। তবে ভারত পেঁয়াজ না দিলে তাতে সমস্যা হবে না। কারণ, দেশি পেঁয়াজ পর্যাপ্ত রয়েছে। অন্যান্য দেশ থেকে আসছে। ফলে বাজারে পেঁয়াজের ঘাটতি হবে না। দামও স্বাভাবিক থাকবে।
#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন