সৃষ্টির সেরা জীব হওয়ার গৌরব শুধু মানুষেরই। মনুষ্যজীবন লাভ করা চরম সৌভাগ্যের কথা। তাই মানুষকে অত্যন্ত সাবধানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে হয়। মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করবে, মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও হাদিসে তা উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া মহানবী (সা.) তার স্বচ্ছ জীবনযাপনের মাধ্যমে যে জীবনাদর্শ আমাদের জন্য রেখে গেছেন, তা অনুসরণ করলে মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণœ রাখতে পারবে। মানুষকে সুন্দর-অবয়ব দান করেছেন পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তা। অন্যদিকে তার মধ্যে এমন অপগুণও দিয়েছেন, যা দ্বারা সে শয়তানকেও হার মানায়। মানুষের মধ্যে যে ভালো গুণগুলো আছে, তার অনুশীলনে তার মধ্যে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। আবার তার মধ্যে যে পশুত্ব আছে, তাকে দমন কিংবা মার্জিত না করলে মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু ঘটে। বিবেক মানুষের অন্তরে আল্লাহর একটি কণ্ঠস্বর। মানুষকে ভালো কাজে বিবেক উৎসাহ যোগায় এবং খারাপ কাজে বাধা দেয়। বিবেকবান মানুষ অন্যায় কাজ করতে পারে না। এটা তাকে সৎকর্ম করতে প্রেরণা যোগায়। জ্ঞান অর্জন করে তার আলোকে পথ চলতে চলতে মানুষের অন্তরে মনুষ্যত্ববোধ প্রস্ফুটিত হয়। মনুষ্যত্ববোধ মানুষকে নীচতা, হীনতা, স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, খুন-খারাবি থেকে বাঁচিয়ে রাখে। জ্ঞানের আলো ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। সৌন্দর্যবোধ, পবিত্রতা, রুচিবোধ, প্রেম, ভালবাসা, ত্যাগ, সেবা প্রভৃতি সৎগুণাবলীর সমাবেশ ঘটে মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন মানুষের অন্তরে। বিবেকবান, চরিত্রবান কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে কারো কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। বরং এ সব লোকের দ্বারা ব্যক্তি, সমাজ, দেশ ও জাতি উপকৃত হয়।
শিক্ষিত, জ্ঞানী, চরিত্রবান, স্বাস্থ্যবান, সাহসী, বিচক্ষণ, দায়িত্ববোধ, দেশাত্ববোধসম্পন্ন নাগরিক গড়ে তোলার জন্য পৃথিবীর সব দেশেই নানা রকম ব্যবস্থাপনা আছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসাগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের এমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে যাতে তারা সৎ গুণগুলো অর্জন করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে। দেশের উন্নতি, সমাজের শৃঙ্খলা, সংহতি ও দেশের নিরাপত্তা এ সকল যুবকের হাতে নিশ্চিন্ত বলে দেশবাসী মনে করে। কিন্তু বিগত দু’দশকের পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এবং বর্তমান হালহকিকৎ প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে যা দেখছি, তাতে আমরা নিরাশ হয়ে আতঙ্কে আঁতকে উঠছি। সন্দেহ জাগছে, আমাদের জীবনযাত্রায় কোথাও যেন গলদ আছে। গলদগুলোকে খুঁজে বের করার সময় এসেছে। এতে বিলম্ব হলে জনগণ ভবিষ্যতে অস্তিত্বের সংকটে পড়েব। প্রচার মাধ্যমের ভাষায়, পৃথিবী আজ একটি ক্ষুদ্র গ্রাম মাত্র, যাকে বলে গেøাবাল ভিলেজ। পৃথিবীর এক প্রান্তের ঘটনা অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায় মুহূর্তেই। পৃথিবীর কোনো জনপদ অস্থিরতা থেকে মুক্ত নয়। প্রতি ঘণ্টায় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যখন চলছে হত্যা, ধ্বংস, মৃত্যু, লুটতরাজ ও বিস্ফোরণ তখন বিশ্বের শান্তিপ্রিয় বিবেকবান মানুষ অক্ষমের মতো তা অবলোকন করছে। ইসরাইলী সেনারা সজ্ঞানে যখন নিরীহ মানুষদের হত্যা করে তখন বেদনাদায়ক হলেও সত্য নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশ ও জাতি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এসব কাজে ইসরাইলীদের না থামিয়ে উৎসাহ দিয়ে সাহায্য করছেন। এতে ইসরাইলী হায়ানারা আরো উৎসাহিত হয়ে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের নির্যাতন ও নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। তাদের বর্বর আক্রমণ থেকে মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বাদ পড়ছে না। হত্যা করা হচ্ছে অগণিত নারী, পুরুষ ও শিশুকে। হায় বিপন্ন মানবতা? হায় মানবাধিকার।
দীর্ঘদিন ধরে যখন ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরে অবাধে চলছে ধ্বংসলীলা। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘ তখন নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অন্যায়কারীকে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা কি নেই এ সংস্থার সংবিধানে? অথচ মানুষের কল্যাণের জন্য গঠিত হয় এ সংস্থা, জাতিসংঘ। আর এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য ধনী, গরিব সব দেশই দিয়ে যাচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা।
মানব সভ্যতার গতি উন্নতির উচ্চশিখরে। চাঁদে মানুষের বিজয় পতাকা উত্থিত হয়েছে। শক্তিশালী পরমাণু অস্ত্রের ভান্ডারে ধনি দেশগুলোর ভাঁড়ার পরিপূর্ণ। অস্ত্রের বেচা-কেনার বাজার সরগরম। প্রতিযোগিতা চলছে মারণাস্ত্র তৈরির। মানুষের বুদ্ধির জয় জয়কার। উত্তর কোরিয়ার মতো ছোট্ট দেশও পরমাণু শক্তিধর হয়েছে। আমেরিকার মতো বৃহৎ শক্তিকেও পাত্তা দিচ্ছে না। বাকী উন্নত দেশের কথা ছেড়েই দিলাম। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পরমাণু অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করলে ভারতও তাই করে, ভারত করলে পাকিস্তানও করে। পৃথিবীর রূপ যেন বদলে যাচ্ছে। একটি মৃত্যুর উপত্যকায় আমাদের বাস। অনিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছি।
এ অসহনীয় অবস্থায় প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কিত হওয়ার চেয়ে ঢের ভালো ছিল হিরোসিমা-নাগাসকির ধ্বংসের আগের দিনগুলো। মাঝে মধ্যে যুদ্ধ, মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভয়াবহতা ছিল। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা ছিল না। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ আমরা প্রতিদিন মৃত্যুভয়ে ¤্রয়িমান। প্রতিদিন মরছে কত নিরপরাধ মানুষ সমাজবিরোধীদের হাতে। সড়কে দুর্ঘটনা ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত ও আহত হচ্ছে মানুষ। বিভিন্ন দেশের সমস্যা ভিন্ন হলেও একটি সমস্যা কিন্তু কমন এবং তা হলো উচ্ছৃঙ্খল যুবশক্তি এবং নৈতিক চরিত্রে দুর্বল বর্তমান প্রজন্ম। উদ্দেশ্যহীন হত্যা, গন্তব্যহীন যাত্রা, বিচ্চিন্ন চিন্তা-ভাবনা ও খেয়াল-খুশিমত জীবনযাপন ইত্যাদি ব্যাধি পৃথিবীর সব দেশেই। আমাদের বাংলাদেশের চিন্তাবিদরা কী ভাবছেন, এ থেকে উত্তরণের উপায়ই বা কী?
আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা আমাদের দেশেও রয়েছে। জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত সরকারের নেয়া উচিত নয়। সরকারের হাতে যে পথ খোলা আছে তা হলো, দেশের ঐক্য, সংহতি ও উন্নয়নকে অব্যাহত রেখে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসা। কিন্তু দেশের সর্বত্র ভ্রষ্টাচার বিভিন্ন নামে বাংলাদেশে শাসন যন্ত্রকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছ দীর্ঘদিন ধরে। দেশের সকল সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পায়নি দেশের চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা। এ ব্যাধির সমাধান সূত্র পেতে হলে নৈতিক চরিত্রের মান উন্নয়নের জন্য প্রত্যেক নাগরিকের কঠিন সাধনা করতে হবে। সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম ও সৎ পথে গমনের মাধ্যমে আমাদের মনের কালিমা ঘুচে যেতে পারে। পাক কুরআনের বাণী থেকে বোঝা যায় চারিত্রিক দৃঢ়তা সৎ গুণাবলীকে প্রস্ফূটিত করে। বিবেকবান, ত্যাগী-নাগরিকবৃন্দের হাতে দেশের কল্যাণ সাধিত হয়।
অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরালে দেখা যায়, চরিত্রহীন, লোভী, স্বার্থসর্বস্ব লোকেরাই দেশের শাসনভার গ্রহণ করে থাকে। তাদের পকেটে যখন প্রজাহিতের অর্থের সিংহভাগ চলে যায় তখন উন্নয়ন কথার কথায় পরিণত হয়। প্রজাদের কল্যাণ পরিকল্পনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। গরিব প্রজাদের জীবনে দুঃখের শর্বরী আর পোহাতে চায় না। বঞ্চিত, শোষিত, জনসাধারণের মনে জাগে বিদ্রোহভাব। এতে উগ্রপন্থীদেরও সৃষ্টি হয়। সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা বিঘিœত হয়। দেশ হয় অস্থিরতার শিকার। কাদের জন্য সমাজের এ বড় বড় সমস্যা মাথা তুলে দাঁড়ায়, তা গবেষণা করে দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
সমাজের এ অবক্ষয় রোধ করতে হলে সরকার ও বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে, দেশের অগ্রজ নাগরিকদের নিজ নিজ গৃহে চরিত্র গঠনের আন্তরিক কৌশল চালাতে হবে। নিজেরা আদর্শ হয়ে ছেলেমেয়েদের আদর্শ জীবনযাপন করতে শিখাতে হবে। যে নিজের পরিবারের উন্নতির জন্য উন্নত মনোভাব নিয়ে সকল কাজ সম্পাদন করার শিক্ষা পেয়েছে, দেশ-জাতির জন্য সৎভাবে সে কাজ করবেই। দেশের জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসকে সম্মান দিতে হবে। তাদের কল্যাণের কাজে ধন-সম্পদ, মেধা ও সাহসকে কাজে লাগাতে হবে। জনসাধারণের কল্যাণে পরিকল্পনাকে শত শতাংশ কাজে লাগিয়ে সরকারের আন্তরিকতার উপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় তার বরং বিপরীত কাজ চলছে।
দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে শাসক ও আমলাদের মধ্যে যে মনোবৃত্তি গড়ে উঠেছে, তাতে জনগণের কাজ করার চেয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যই প্রবল প্রতীয়মান হচ্ছে। ভ্রষ্টাচারী কর্মচারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে, আন্তরিকতার সাথে সরকারি নীতিকে কাজে রূপায়ণকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদোন্নতি হওয়া উচিত। এটা তাদের কর্মে প্রেরণা যোগাবে। কিন্তু তা করা হচ্ছে বলে মনে হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, যোগ্যরা বাদ পড়ে অদক্ষ এবং অযোগ্যরা সুযোগ পায়। এটা কোনভাবেই শুভ লক্ষণ নয়।
দীর্ঘদিনের বঞ্চিত জনগণের উন্নয়নের পরিকল্পনাগুলোকে সরকারের কড়া নজরদারিতে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর রূপায়িত হলেই জনগণের আস্থা ফিরে আসবে সরকারের উপর। আমাদের সৎ গুণাবলী পুনরায় অর্জন করতে হবে। ভ্রষ্টাচারে ডুবে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে নব চেতনার সৃষ্টি করতে হবে। বুঝাতে হবে, জনসেবাই তাদের মূল লক্ষ্য। একবার শাসককূলের মনে সততার উদয় হলে দেশে আর বিশৃঙ্খলা, অশান্ত পরিবেশ ও হাহাকার থাকবে না। মানুষ সুন্দর, সৎভাবে চলার পথ খুঁজে পাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন