বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

শিক্ষায় সময়োপযোগী পরিকল্পনা নিতে হবে

মশি শ্রাবন | প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:১০ এএম


করোনার ছোবলে বিপর্যস্ত দেশের শিক্ষা খাত। বন্ধ রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্থগিত রয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা। করোনা মহামারীতে প্রকট হচ্ছে সেশনজটের আশঙ্কা। করোনার বিস্তার রোধে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সীমিত এবং প্রায় সব শিক্ষা কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়েছে বেশির ভাগ দেশে। কার্যত সারা পৃথিবীর শিক্ষাব্যবস্থাই এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিবিষয়ক নানা পরিকল্পনার কথা আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছি। প্রাথমিক পর্যায়ে সংশোধিত লেসন প্ল্যান তৈরি করেছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি-নেপ। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী অক্টোবরে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরকার স্কুল খুলে দিলে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্লাস চলবে। এরপর পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করা হবে শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া নভেম্বরে স্কুল খোলা গেলে ৪০ দিন পাঠদান করে মূল্যায়ন করা হবে। আর করোনার কারণে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না যায় সে ক্ষেত্রে পরীক্ষা বা মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে না। তখন পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন দেওয়া হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ে তারা একটি ওয়ার্কপ্ল্যান তৈরি করে দেশের ৬৪ হাজার ৬২০টি স্কুলে প্রয়োগ করবেন।

ইতোমধ্যে বাতিল হয়েছে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণির জেএসসি, জেডিসি পরীক্ষা। অন্যদিকে দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চলমান থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান চলছে না। সে হিসেবে উচ্চবিদ্যাপীঠে অধ্যয়নরত বৃহদাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

করোনার প্রভাবে শুধু শিক্ষার্থী নয় শিক্ষকরাও বিপাকে পড়েছেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেসরকারি নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা নামমাত্র কিছু বেতন পেয়ে থাকেন। কোথাও কোথাও তাও পান না। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফিও বন্ধ। কারিগরি শিক্ষার প্রসারে দেশে বেসরকারি উদ্যোগে ৫৫৩টি বেসরকারি পলিটেকনিক গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান শুধু শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের বেতন-ভাতার সংস্থান হচ্ছে না। করোনারভাইরাস আরও দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করবে। দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার প্রায় ৯৭ শতাংশ বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হয়। শিক্ষা খাত বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিনিধি ও শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অংশ থেকে শিক্ষার জন্য একটি বিশেষ ফান্ড গঠন করা প্রয়োজন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেড়েছে বহুগুণ। বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রথম ধাপ হলো শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিতি। আর ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। করোনার ছুটিতে একদিকে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় ধরে শ্রেণিকক্ষের বাইরে থাকছে, অন্যদিকে কর্মের সুযোগ না থাকায় আয় বন্ধ হয়েছে হাজারো পরিবারের। তাই করোনার এ দীর্ঘ ছুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন: অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স রিপোর্ট ২০১৯’ (এএসপিআর) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের ১৮ দশমিক ৬ শতাংশই পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার আগে ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার প্রথম শ্রেণিতে ১ দশমিক ৯ শতাংশ, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২ দশমিক ৭, তৃতীয় শ্রেণিতে ৩ দশমিক ৪, চতুর্থ শ্রেণিতে ৮ দশমিক ৪ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি মাধ্যমিকে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রকাশিতব্য শিক্ষা পরিসংখ্যান প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৩। এর মধ্যে ছাত্রী ৫৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ। মাধ্যমিকে এসব শিক্ষার্থীর ৩৬ দশমিক ৭৩ শতাংশই দশম শ্রেণি শেষ করার আগে ঝরে পড়ে।

ইন্টারনেট ও ডিভাইস সুবিধার অভাবে অনলাইন পাঠদান থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্টফোন নেই। এছাড়া ইন্টারনেট সংযোগ ও ডেটা ক্রয়ের সক্ষমতার অভাবে ডিভাইস থাকাদের অনেকেই অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছে না।

করোনায় দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)। সম্প্রতি এক পলিসি ব্রিফের মাধ্যমে সংস্থাটি জানিয়েছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৩৬ হাজার ৮৪৩ শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে মেয়ে ২ কোটি ২১ লাখ ৫ হাজার ৫৮৯ এবং ছেলে ১ কোটি ৯৭ লাখ ২১ হাজার ২৫৪ জন। যার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে ১ কোটি ১৮ লাখ ৫ হাজার ৮২৫ জন, প্রাথমিকে ৮৭ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩ জন, মাধ্যমিকে ৮৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৬ জন এবং ১২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮৫ জন উচ্চশিক্ষায়। এছাড়া ২ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

এদিকে নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে পরীক্ষা সিলেবাস অসম্পূর্ণ রেখে কোনো ধরনের মূল্যায়ন ছাড়াই অটো প্রমোশনের কথা বলা হচ্ছে। যদিও শিক্ষাবিদরা বলছেন, সিলেবাস অসম্পন্ন রেখে অটো আপগ্রেডেশনের মাধ্যমে শিক্ষায় বড় শূন্যতা তৈরি হবে। দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষাব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন তারা। পরিশেষে বলবো, শিক্ষাকে অবহেলা করে আমরা আগামীর করোনামুক্ত পৃথিবীতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাব না, কখনই না। সুতরাং শিক্ষা নিয়ে আমাদের সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা নিতে হবে।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক দৈনিক মাতৃভূমি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন