শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য রুখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:১০ এএম

আমাদের শিশু-কিশোর সন্তানরাই আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যত। তাদের চোখেই জাতি আগামীর স্বপ্ন বোনে, স্বপ্ন দেখে। স্কুল-কলেজে পড়–য়া সেই কিশোর সন্তানরা যদি ভয়ঙ্কর গ্যাং কালচারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাদের দ্বারা যদি সমাজে সন্ত্রাস, অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার অপরাধচক্র গড়ে ওঠে তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ দূরূহ হয়ে উঠতে পারে। রাজধানীসহ সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের ক্রমবর্ধমান দৌরাত্ম্য আমাদেরকে সেই আতঙ্ক ও আশঙ্কার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে ৩২টি সক্রিয় কিশোর গ্যাং গ্রপের তথ্য তুলে ধরা হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডেই বিভিন্ন স্তরের ছোটবড় গ্যাং গ্রæপের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষাবঞ্চিত ছিন্নমূল শিশু-কিশোর, গণপরিবহন ও কলকারনায় কাজ করা কিশোররাও নিজেদের মত করে গ্রæপকে তৈরী করে নিজেদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে শো-ডাউন করছে। এদের মধ্যেই কোনো কোনো গ্রæপ আন্ডারওর্য়াল্ডের পেশাদার সন্ত্রাসীদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যাচ্ছে। এরা নিজ নিজ এলাকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নিজেদের মধ্যে দ্ব›দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে রক্তারক্তি খুন-খারাবির ঘটনাও ঘটাচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার খবর বেরিয়েছে।

বৈশ্বিক করোনা মহামারীর এই সময়ে সারাবিশ্বেই অপরাধ প্রবণতা, হানাহানির ঘটনা কমেছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ার পেছনে চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার দায় অস্বীকার করা যাবে না। দেশে হঠাৎ করেই কিশোর গ্যাংয়ের অভ্যুদয় ঘটেনি। বিগত দশকে ইভটিজিং নিয়ে ব্যাপক সামাজিক-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে জনসচেতনতামূলক তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। এর সুফলও পাওয়া গেছে। সেই ইভটিজাররাই একসময় সংঘবদ্ধ হয়ে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ভিত্তি তৈরী করেছে। ঢাকা শহরে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য নিয়ে গত ৫-৭ বছর ধরেই লেখালেখি হচ্ছে। ২০১৭ সালে রাজধানীর উত্তরায় দুই কিশোর গ্যাংয়ের সংঘাতের জেরে স্কুলছাত্র আদনান নিহত হওয়ার পর গ্যাং কালচারের স্বরূপ এবং এর প্রতিকার নিয়ে একটি সামাজিক সচেতনতা এবং দাবি উঠে আসে। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। কিন্তু কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধের মূল ক্ষেত্র রচিত হয় পারিবারিক পরিবেশ, পিতা-মাতা আত্মীয় পরিজন ও প্রতিবেশিদের নিয়ে গড়ে ওঠা সামাজিক পরিবেশে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক পরিবেশের অনুপস্থিতি, স্যাটেলাইট চ্যানেলে অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা প্লাটফর্মের বল্গাহীন ব্যবহার ও আসক্তি পারিবারিক-সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে হতাশ কিশোর-তরুণরা মাদাকাসক্ত ও অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র পুলিশি ব্যবস্থায় এর প্রতিকার সম্ভব নয়।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড, নাশকতা ও সন্ত্রাসের ঘটনা উঠে এসেছে। একশ্রেণীর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজরাও সংঘবদ্ধ উঠতি বয়েসী কিশোরদের ব্যবহার করে থাকে বলে অভিযোগ আছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ এবং প্রতিপক্ষের সাথে বিরোধ মোকাবেলায় অর্থের বিনিময়ে এদের ব্যবহার করা হয়। তবে কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় দায় পরিবারের। সেই সাথে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষক সমাজের দায়হীন ভূমিকাও এর জন্য দায়ী। শিক্ষা কারিকুলামে ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ চর্চা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রতি আসক্তি সমাজে অমানবিক র্নীতিহীন প্রতিযোগিতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক-মুনাফাবাজির মনোবৃত্তি, সরকারি প্রশাসনের প্রতিটি সেক্টরে ঘুষ-দুর্নীতি, অপচয়-লুটপাট ও অস্বচ্ছ প্রতিযোগিতা আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। ইভটিজিং, কিশোর গ্যাং কালচার, মাদকাসক্তি, খুন-ধর্ষণ, চাঁদাবাজির মত সামাজিক ব্যাধি নিরাময়ের জন্য এর মূলে হাত দিতে হবে। বিশেষত: অপরাধী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের পাশাপাশি তাদের পিতামাতা বা অভিভাবকদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে নতুন ভাবনা-চিন্তার সময় এসেছে। পারিবারিক পরিবেশ ও পারিবারিক মায়ামমতার বন্ধনকে সুদৃঢ় করে এমন সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তোলার সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। শিশু-কিশোররা অপরাধি হয়ে জন্মায় না, আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক পরিবেশই তাদেরকে অপরাধী ও আত্মবিদ্ধংসী করে তোলে। আগামীর সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অপরাধ-দুর্নীতির মূল কারণগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি প্রতিকারের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কিশোর গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে সারাদেশে একটি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack Ali ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৮:১০ পিএম says : 0
Only answer that we need to establish the Law of Allah. Allah's curse upon those who are destroying our Beloved Country. Ameen
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন