বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

নদীভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চাই

তৌহিদুর রহমান তুহিন | প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০৫ এএম

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এখানে ঝড়-ঝঞ্চা, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। নদীভাঙনও তেমনি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্লাবন ভূমির প্রায় ৫ ভাগ এর ধারা প্রভাবিত হয়। নদীতে যখন প্রচন্ড গ্রোত থাকে তখন এই স্রােত দুই পাড়ের ক্ষয় ঘটায়। প্রতি বছর বর্ষার শুরু হতে শেষ পর্যন্ত নদীভাঙন চলতেই থাকে। সেখানে মাঝে মাঝে সাময়িক প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরি করলেও তা স্থায়ী এবং টেকসই হয় না। ফলে নদীভাঙা পুনরায় শুরু হয়। দেখা যায়, নদীভাঙনে কোনো কিছুই আর বাকি থাকছে না। মানুষের বসতভিটা, হাটবাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি স্থাপনা, ধর্মীয় স্থাপনা, চিকিৎসা কেন্দ্র সব কিছুই নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে। আর ভুক্তভোগী হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার।

নদীভাঙন কেন হয়? বাংলাদেশ প্রধানত নদীমাতৃক দেশ। প্রায় ৭০০ এর উপরে নদী রয়েছে দেশে এবং এদের সম্মিলিত দৈর্ঘ্য হচ্ছে ২৪০০০ কিলোমিটারের বেশি। ভাঙন সবচেয়ে বেশি হয় বর্ষাকালে এবং সাধারণত বন্যার ফলে। এছাড়াও, অন্যান্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে নদী ভাঙ্গনের, যেমন- অতিরিক্তি বৃষ্টিপাত, নদী পাড়ের বৃক্ষ কর্তন, তীব্র গ্রোত ইত্যাদি। ভূতাত্তি¡ক আকারের কারণেও ভাঙন হয়ে থাকে। কারণ এ ভাঙন নির্ভর করে নদীতীরের মাটির গঠন, তীরবর্তী প্রবাহের তীব্রতা, নদীর প্লানফর্ম এবং নদীতে পানি ও অবক্ষেপের সরবরাহ ইত্যাদির ওপর। যেমন- যমুনা নদীর প্রস্থ বেশি গভীরতার তুলনায়। যখন পানি উজান থকে সাগরের দিকে যেতে থাকে তখন অতিরিক্ত চাপের ফলে দুই পাড়ের কয়েক মিটার ভেঙে যায়। আবার নদী যখন পানিতে পূর্ণ হয় তখন তীব্র গ্রোত দুই পাড়ে ব্যাপক ভাঙন সৃষ্টি করে। বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, ১৯১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পদ্মার ভাঙনে পড়েছে মোট এক হাজার ৭৪৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা। পদ্মার তীব্র গ্রোতের কারণে এটিকে বলা হয় বিশ্বের তীব্র ভাঙ্গন প্রবণ নদী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সবচেয়ে ভাঙনপ্রবণ এলাকা হল- বগুড়া, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মাওয়া, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুর এবং ময়মনসিংহ। তবে সীমান্তবর্তী পাহাড়ি নদীগুলোও বর্ষাকালে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।

বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এর তথ্যমতে, ১৯৭৩-২০০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভোলার মূল ভূ-ভাগ থেকে ২৪০ বর্গ কিলোমিটার জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কোপেনহেগেনে জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (২০০৯) বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত প্রতিবেদনগুলোর একটিতে জানানো হয়, পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার জুড়ে ভাঙন অব্যাহত আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ৪৮৯টি থানার মধ্যে প্রায় ৯৪টি থানায় নদীভাঙন ঘটছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ এর সঙ্গে আরও ৫৬টি থানার সন্ধান পেয়েছন যেখানে নদীভাঙনের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে প্রায় ১০০টি থানায় নদীভাঙন ও বন্যার দুর্ভোগ নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৩৫টি থানা সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ। প্রতি বছর নেত্রকোনা জেলার সোমেশ্বরী নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকার বস্তিগুলোর উপর পরিচালিত একটি সংস্থার জরিপে দেখা যায়, ছিন্নমূল পরিবারের অধিকাংশই এসেছে ফরিদপুর, বরিশাল , কুমিল্লা ও ঢাকার আসে পাশের এলাকা থেকে। আরও নিবিড় বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, এসব বস্তিবাসীর অধিকাংশই আবার পদ্মা-মেঘনার মোহনার আশপাশে অবস্থিত কয়েকটি থানা থেকে এসেছে। নদী ভাঙনের ফলে স্থানচ্যুতির ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরো পরিবারই পথে বসে। অনেক পরিবার তখন সবকিছু হারিয়ে বাঁধের উপর আশ্রয় নেয়। নদীভাঙনে আশ্রয়হীন যেসব পরিবার বিভিন্ন বাঁধের উপর অস্থায়ী নিবাস গড়ে তুলেছে, তারাই সবচেয়ে বঞ্চিত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নদীভাঙনের কারণে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং বিপদাপন্ন লোকের সংখ্যা আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীভাঙনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের জমি, বসতভিটা, ফসল, গবাদি সম্পদ, গাছপালা, গৃহসামগ্রী সবকিছুই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষভাবে নদীভাঙনের শিকার হয়। নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ভাঙনের ফলে গ্রামীণ কৃষিকাজ দারুণভাবে ব্যাহত হয়। বসতভিটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কৃষিজমি, অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্বক বিপর্যস্ত হয়। একদিকে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর কৃষি আয় কমে যায় অন্যদিকে দেখা দেয় ঐ অঞ্চলে খাদ্য ও পুষ্টির ঘাটতি। আবার নিচু জমিতে নদীর পানি প্রবেশ করে তা ফসলের অনুপযোগী করে দেয়। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) তথ্য মতে, প্রতিবছর ভাঙনে নদীতে চলে যায় প্রায় চার হাজার হেক্টর জমি। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় লাখখানেক পরিবার।

নদীর দুই পাশের ভূখন্ড সাধারণত অপরিণত ও দুর্বল নরম মাটি দিয়ে গঠিত হওয়ার ফলে বর্ষার সময় পানিপ্রবাহ বেড়ে গেলে তখন নদী ভাঙন বেড়ে যায়। আর এ ধরণের একটি নদীর ভাঙন সামলাতে প্রতিবছর যেভাবে বিভিন্ন স্থানে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা আসলে তেমন কোনো কাজে আসেনা। নদী রক্ষা বিষয়ক গবেষণা প্রতিবেদনগুলোতে মূলত বন্যা ও বন্যার সঙ্গে আসা বিপুল পরিমাণ পলিমাটিকে এই ভাঙনের জন্য দায়ী করা হয়েছে, সেই সঙ্গে তীব গ্রোত, রয়েছে নদী শাসনগত সমস্যা। বর্তমানে আমরা যেভাবে নদী ভাঙন রোধ করতে চাই তা আসলে আধুনিক ও মানসম্মত পদ্ধতি নয়। ফলে এই নদী রক্ষা বাঁধ গুলো স্থায়ী হয় না বা সামান্য বর্ষণে ভেসে যায়। এর মূল কারণ হচ্ছে নদীর দুই পাড়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নে আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ না করা।

হয়ত নদীভাঙন সমস্যার খুব দ্রুত সমাধান হবে না কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা মাফিক কার্যক্রম হাতে নিলে নদীপাড়ের মানুষের দুঃখ কিছুটা হলেও লাগব হতো। প্রথমত নদীর নিকটবর্তী পরিবারগুলোকে অন্যত্র সরিয়ে আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং কার্যক্রমের বিকল্প নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- নদীর পাড়ে স্থায়ী অবকাঠামো (সিমেন্টের ব্লক, কংক্রিট উপাদান দিয়ে এক ধরণের শিলা খন্ড) গড়ে তুলতে হবে। সেই সাথে নদীর নাব্যতা যেন ঠিক থাকে সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে। এক্ষেত্রে নদী তীরের ক্ষয় রোধ করতে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপণের বিকল্প নেই। এক্ষত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে আধুনিক প্রযুক্তির যোগ করতে হবে। প্রতি বছর যে হারে নদীভাঙনে মানুষের ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে ক্ষতির পরিমাণ আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকবে। এতে শুধু ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ বা অঞ্চল না, পুরো দেশকেই তার ভার বহন করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন