বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পেঁয়াজের পর চালের দামও বাড়ছে

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ২ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৭ এএম

(১) ‘চালের দাম বাড়ছেই, পেঁয়াজের দামও কমছে না’; (২) ‘পণ্যমূল্য আঁকাশ ছোঁয়া’ এবং (৩) ‘পাইকারী বাজারের সাথে ভোক্তামূল্যে এতো ফারাক কেন?’ এসব ক’দিন আগের পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম। চাল, পেঁয়াজ, সব্জির দাম বাড়ছেতো বাড়ছেই। প্রতিদিনই কমবেশি চালের দাম বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে মানভেদে ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, পেঁয়াজের দামও বাড়ছে। দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৯০ টাকা ও আমদানি করা পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকায় রাজধানীর বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ক্ষেত্রভেদে সেটা একশ’ টাকার উপরেও বিক্রি হচ্ছে। এক মাস আগেও এ পেঁয়াজ যথাক্রমে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ও ৩০ থেকে ৩৫ টাকা ছিল। তেলের দামও বাড়ছে।

করোনা সংকটে মানুষের আর্থিক সঙ্গতি কমেছে। মানুষের পকেটে পয়সা নেই। পণ্যের চাহিদা এ কারণে আগের চেয়ে কম। তাহলে পণ্যমূল্য এভাবে বাড়ছে কেন? ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হবার ঘোষণার পরই (সেদিনই) কিন্তু দেশে পেঁয়াজের সংকট শুরু হয়নি। তারপরও সাথে সাথেই লাফিয়ে লাফিয়ে পেঁয়াজের দাম বাড়লো কেন? তখন পর্যাপ্ত আমদানি করা পেঁয়াজ ছিলো বাজারে। হুট করে অস্বাভাবিক দাম বাড়াটা অযৌক্তিক। বাজার যে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই সেটা স্পষ্ট এখানে। দেশের মজুতদাররা যে সবসময় সক্রিয় তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। চাল, সব্জি, তেলসহ অন্যসব পণ্যের এভাবে দাম বাড়ার কারণ আছে কি? বর্ষা-বন্যায় এসব পণ্যের দাম কিছুটা বাড়ে তবে এবার যেভাবে বেড়েছে ততটা নয়। চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া সত্তে¡ও তার সুফল অনেক সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় পরিবহন চাঁদাবাজি ও মজুদদারির কারণে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম এভাবে বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। সারাদেশে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভাগীয় এবং জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। কিন্তু তাতেও কি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আছে? বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আর জেলাপ্রশাসনের তাবৎ হুমকি ধমকিকে কি পাত্তা দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা? উল্টো পেঁয়াজের দামে আগুন লাগিয়ে ছেড়েছে। চালেও চলছে চালবাজি।

আমরা আসলে সবাই রাজা! কারোরই অর্থকড়ির অভাব নেই! তাই ১ টাকার জিনিস ২ টাকায় কিনতেও নেই সমস্যা। ভাবখানাতো এমনই। বাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে অবিশ্বাস্যভাবে। জনগণ বাড়তি দামে এসব পণ্য কিনছে না তা কিন্তু নয়। পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের এতো দাম! তবুও দেশের কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই। আমজনতার মুখে কুলুপ আঁটা। পেঁয়াজ ৩৫ টাকা থেকে কয়েকদিনের ব্যবধানে ১শত টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। কোনো কোনো পণ্য ৩০/৪০ টাকা থেকে লাফিয়ে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কাঁচামরিচ, বেগুন ও অন্যান্য সব্জি সবকিছুর দামই বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ তিনগুণ হয়েছে। ২০ টাকার শসা বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। কাঁচামরিচ ক’দিন আগে ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে। আর মাছ-মাংসের দামতো আগে থেকেই বেড়ে আছে। ভরামৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া। কেজি প্রতি পাঙ্গাস ১৪০-১৬০, সিলভার কার্প ১৬০-২০০, শিংমাছ ৬০০-৮০০, তেলাপিয়া ১৮০-২২০, দেশি মাগুর ৬০০-৮০০, চায়না পুঁটি ১৫৫-১৯০। দেশি আলু (লাল) ৪০, করলা ৬০-৮০, পটোল ৬০, কাকরোল ৫৫-৬০, চিচিঙ্গা ৫০-৬০, মিষ্টি কুমড়া (কাটা পিস) ২৫-৪০, লাউ ৪০-৬০, কচুর লতি ৫০-৬০, গাঁজর ৪০-৫০ টাকা, পেঁপে ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

সরবরাহ বাড়াতে ভারত ছাড়াও বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত আমদানি হলেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। প্রশ্ন হলো, তবে কি দেশে পেঁয়াজ মজুত নেই বা ছিলো না? বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারা গেছে, দেশে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করেই ইচ্ছা অনুযায়ী পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে রাতা-রাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, প্রতিবছর দেশে ১৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবেই উৎপাদন হয় প্রায় ১২ লাখ টন। আর চাহিদার মাত্র ৩ লাখ টন পেঁয়াজ বছরের বিভিন্ন সময়ে আমদানি করা হয় ভারত থেকে। মানুষের পকেট মেরে রাতারাতি বাড়ি-গাড়ি আর ব্যাংক ব্যালেন্স করার জন্যই এসব করা হচ্ছে। পণ্যের দাম বাড়তেই পারে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। ফি বছরই বাড়ে। তবে সকালে ৬০ দুপুরে ৮০ আর রাতে ১০০ টাকা- এভাবে কি পৃথিবীর আর কোনো দেশে দাম বাড়ে?

এ দেশে হুট হাট পণ্যমূল্য বাড়ে; বাড়ে জনগণের নাভিশ্বাস। যেকোনো অজুহাত মানেই পণ্যমূল্যের উল্লম্ফন অতি সাধারণ ঘটনা। আসলে মানুষকে জিম্মি করে অধিক মুনাফা লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা এই খেলা খেলে। এ খেলা সরকার বন্ধ করতে পারে না, একথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সরকারের সৎ ইচ্ছা থাকলে এই খেলা বন্ধ করা অবশ্যই সম্ভব। এজন্য সরকারকে অবশ্যই হার্ড লাইনে যেতে হবে। চিহ্নিত করতে হবে অসাধু ব্যবসায়ীদের এবং তাদের দমনে নিতে হবে কঠোর ব্যবস্থা।

অর্থনীতিতে একটা কথা আছে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন যতো কম হবে পণ্যের দাম ততো বেশি হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়। চারদলীয় জোট সরকার এবং বর্তমান সরকারের সময় দেখেছি, যতবার পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, ততবার দাম বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা সরকারকে বারবার আশ্বাস দিয়েছে, পণ্যের দাম বাড়বে না। কিন্তু বাস্তবে তা তামাশা মাত্র! তার কোনো প্রভাব কখনই বাজারে পড়ে না। দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য অসৎ ব্যবসায়ী সব সময়ই বেপরোয়া। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠিও বরাবরই পণ্যমূল্য বাড়িয়ে তাদের পকেট স্ফীত করে চলেছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। এজন্য বিরোধীদলগুলোকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবে আর চলতে পারে না। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে বর্তমান পরিস্থিতিতে যা করা দরকার তাহলো: সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণে নেয়া পদক্ষেপগুলো কার্যকর করতে হবে। যেকোনো মূল্যে মধ্যস্থানীয় শ্রেণির কারসাজি বন্ধ করতে হবে। সরকারকে ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যের সামঞ্জস্য আছে কিনা নিয়মিত তদারকি করতে হবে। সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বাজারে যে পণ্যের চাহিদা বেশি, তা বেশি করে যোগান দিতে হবে। পাইকারি বাজার থেকে মধ্যসত্ত¡ভোগী গোষ্ঠি যাতে স্বার্থ হাসিল না করতে পারে, সেজন্য পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত সরকারি নিজস্ব পরিবহন ও জনবলের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া যেতে পারে। তাতে করে চাঁদাবাজদের চাঁদাবাজিও বন্ধ হবে। বেশি করে পণ্য আমদানি করে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করতে হবে। আরো বেশি করে সরকারি বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন