স্পোর্টস ডেস্ক : তাঁকে আউট করা ছিল বোলারদের জন্য কঠিনতম পরীক্ষা। ব্রিজটাউন টেস্টে সেই ৯৭০ মিনিট টানা ব্যাটিংয়ের রেকর্ড ৫৮ বছরেও ভাঙতে পারেনি কেউ। কিংবা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সেই ৪৯৯ রানের ইনিংস? সেই হানিফ মোহাম্মদ জীবনের আসল ইনিংসে আর নটআউট থাকতে পারলেন না। কেউ পারেও না শেষ পর্যন্ত। তবে তিনি ক্রিকেটের আসল লিটল মাস্টার বলেই ক্যানসার নামের সেই জীবনঘাতী ‘বোলারটা’কেও নিখুঁত রক্ষণে খেলেছেন টানা তিন বছর। কিন্তু আর পারলেন না। গতকাল অনেককেই চমকে দিয়ে ছয় মিনিট হৃৎস্পন্দন বন্ধ থাকার পরও আবারও বেঁচে ফিরেছিলেন। কিন্তু তারপর কার্ডিও মনিটরে রেখাটি স্থির সরল হয়ে গেল। ৮১ বছর বয়সে মারা গেছেন পাকিস্তানের এই সাবেক ব্যাটসম্যান।
প্রথম দফায় অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন বলে সে সময় চিকিৎসকদের ভুল বার্তায় আগেই মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে আরও কিছুক্ষণ কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার পর আর পারলেন না হানিফ। কয়েক ঘণ্টা পর নিশ্চিত করা হয়েছে, করাচির একটি হাসপাতালে মারা গেছেন ক্রিকেটে সবচেয়ে বিখ্যাত মোহাম্মদ পরিবারের সবচেয়ে বিখ্যাতজন- যে পরিবার থেকেই টেস্ট খেলেছেন পাঁচজন।
ক্রিকেটে এখন চলছে মারকাটারি যুগ। কিন্তু কেবল ধৈর্যের গুণেই যে দলকে ম্যাচ পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করা যায়, নায়কোচিত ইনিংস খেলে জাতীয় বীর হওয়া যায়, সেটাই দেখিয়েছিলেন হানিফ মোহাম্মদ। ১৯৫৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে গড়েন এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। বারবাডোজে ৯৭০ মিনিট ব্যাটিং করেছিলেন হানিফ! যা ছিল ১৬ ঘণ্টা এবং ১১টি ফুটবল ম্যাচের দৈর্ঘ্যরে চেয়েও বেশি! ১৭ জানুয়ারি শুরু হওয়া পাঁচ ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্টে টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কনরাড হান্ট, রোহান কানহাই, এভারটন উইকস, ক্লাইড ওয়ালকটের সঙ্গে ব্রিজটাউনের সেই টেস্টে ২১ বছর বয়সী গ্যারিফিল্ড সোবার্সের সমন্বয়ে গড়া ব্যাটিং লাইন আপ যেকোনো দলের জন্যই ছিল ঈর্ষণীয়। প্রথম ইনিংসে ৯ উইকেট ৫৭৯ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
তৃতীয় দিনের শুরুতে ১০৬ রানে অলআউট হয়ে যায় পাকিস্তান। ফলোঅনে পড়ে একই দিনে দ্বিতীয়বারের মতো ব্যাট হাতে মাঠে নামেন প্রথম ইনিংসে ১৭ রান করা হানিফ। ষষ্ঠ দিনের শুরুতেও যখন ব্যাট করছিলেন, ম্যাচ বাঁচানোর পাশাপাশি হানিফের সামনে ছিল অনেকগুলো মাইলফলক পেরোনোর হাতছানি। ৩০০ রান করে কেবল নিজের নয় তুলে নেন এশিয়ার প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরির গৌরব। সুযোগ ছিল ১৯৩৮ সালে করা লেন হাটনের ৩৬৪ রানের রেকর্ড ভাঙার। কিন্তু প্রথম ইনিংসের হন্তারক অ্যাটকিনসনের বলে আলেক্সান্ডারের হাতে ক্যাচ দিয়ে হানিফ যখন প্যাভিলিয়নে ফেরেন, তখনো সেই লক্ষ্য ২৮ রান দূরে। যদিও আলোচিত এই সিরিজেরই তৃতীয় টেস্টে ৩৬৫ করে সোবার্স ভাঙেন সেই রেকর্ড।
২৩ জানুয়ারি শেষ হয় দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টার এক ম্যারাথন ইনিংস। ৯৭০ মিনিট ক্রিজে থেকে হানিফ ৩৩৭ রান করেন ৬০৩ বল খেলে। চার মেরেছেন ২৪টি। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী হানিফ ইনিংসে রানের তুলনায় সময়ের মাহাত্ম্য এতটাই বেড়ে দাঁড়ায় যে স্কোরার হানিফের ইনিংসটার সময় নির্ভুল দেখালেও বলের সংখ্যায় তারতম্য হতে পারে বলে জানান। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে থাকা পাকিস্তান ৩১৯ ওভারে ৮ উইকেটে ৬৫৭ রান করে ইনিংস ঘোষণার গৌরবও দেখায়।
ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলারদের করা ৩১৯ ওভারের ১১৩টি মেডেন ওভারই বুঝিয়ে দেয় হানিফের সঙ্গে সেই টেস্টে পুরো পাকিস্তানই যেন ধৈর্যের একাগ্রতায় মনোনিবেশ করেছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১১ ওভারে ২৮ রানে দিন শেষ করলে টেস্টটি ড্র হয়। জয়ের সমান এই ড্রয়ে পাকিস্তান অবশ্য উজ্জীবিত হতে পারেনি পরের টেস্টগুলোয়। যার ফল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ জেতে ৩-১ ব্যবধানে।
পাকিস্তান না পারলেও হানিফ ৩৩৭ রানের এই ইনিংস দিয়ে জয় করে নেন সবার হৃদয়। ৯৭০ মিনিটের এ ইনিংসটি এখনো টিকে আছে টেস্টের দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ড হিসেবে, ৫৮ বছর পরও। দেশের বাইরে করা ট্রিপল সেঞ্চুরির মধ্যে এটি এখনো সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। আর এটিই এখনো একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরি, যেটি খেলা হয়েছিল দলের দ্বিতীয় ইনিংসে। দীর্ঘক্ষণ ক্রিজে টিকে থাকলেও মাত্র ১৭ বছর বয়সে অভিষিক্ত এই ওপেনার ম্যাচ কিন্তু খেলেছেন মাত্র ৫৫টি। ৪৩.৫ গড়ে ৯৭ ইনিংসে সর্বোচ্চ স্কোরটি ঐ ইতিহাসগড়া ৩৩৭। সেঞ্চুরি আছে ১২টি, ডাবলস ২টি আর ফিফটির দেখা পেয়েছেন ১৫টি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটসহ সবমিলিয়ে ৫৫.৩২ গড়ে শতক ৫৫টি।
সুনীল গাভাস্কার এসেছেন, এর পর শচীন টেন্ডুলকারও। তবুও ক্রিকেটের আদি ও আসল লিটল মাস্টার তিনিই। সেই হানিফও চলে গেলেন। তারপরও রেকর্ড বইয়ের পাতায় তিনি থেকে যাবেন অমর। এই গুণী ক্রিকেটযোদ্ধার ইন্তেকালে শোকের সাগরে ভাসছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন