শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

প্রথা ভেঙে ও হুমকি মোকাবিলা করে চাকরি করতে চায় ভারতীয় নারীরা

প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : গত গ্রীষ্মে এক আর্দ্র, ঘামঝরানো দুপুরে দুই মহিলা ভারতের উত্তর প্রদেশের মিরাটের আদালত কমপ্লেক্সে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস খুঁজছিল। স্ট্যাম্প পেপার ও এফিডেভিটের স্তূপ, টুলের ওপর বসা সারি সারি টাইপিস্ট, ব্যস্ত পায়ে ছুটে চলা গাউন পরিহিত উকিল-ব্যারিস্টার, টাল করে রাখা ফাইলের পাহাড় তারা পেরিয়ে যেতে থাকে। তারপর পৌঁছে তাদের উকিলে অপরিসর, ঘামের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠা কক্ষটিতে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী নি¤œশ্রেণির নাত সম্প্রদায়ের এ মহিলারা মিরাট থেকে ১০ মাইল দূরের ছোট একটি গ্রাম পিপলিখেরা থেকে এসেছে। তাদের জীবনের বড় সময় কেটেছে জ¦ালানি কাঠ-কুটো কুড়িয়ে তা মাথায় করে বাড়ি বয়ে এনে। নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন তারা চেয়ারের দিকে না এগিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। এ মহিলারা হচ্ছে গীতা ও প্রেমবতী। তাদের বাড়ি থেকে হাঁটা পথে এক ঘণ্টা দূরত্বে একটি মাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় তারা কাজ করে। তারা উকিলের কাছে এসেছিল মামলা করার জন্য। গ্রামের সমাজপতিরা তাদের কারখানায় কাজ করতে দেয়া হবে না বলে বিধান দিয়েছে, কিন্তু তারা কাজ করবে। এ জন্য মামলার মাধ্যমে আইনের সাহায্য নিতে এসেছে তারা।
গীতা ও প্রেমবতীর বসতিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভিক্ষাই হচ্ছে আয়ের প্রধান উৎস। তারা দু’জনসহ গ্রামে ৭ জন নারী কারখানায় কাজ নিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে সমাজপতিরা বিধান দিয়েছে যে কাছের মাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় কর্মরত গ্রামের মহিলাদের কাজ ছাড়তে হবে। এর কারণ হিসেবে তারা যা বলেছে তা হলো বাইরে মহিলারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাই নিরাপত্তার জন্য তাদের ঘরে থাকাই উত্তম। আসল কথা হলো, নারীরা নিজ শ্রমে টাকা আয় শুরু করে আর পুরনো রীতিনীতি মানতে চাইছে না।
৭ জন মহিলার দৈনিক মজুরি ২শ’ রুপি (৩ ডলার)।  তারা যখন প্রবীণদের কথামতো কাজ ছাড়তে অস্বীকার করল তখন পুুরুষরা ক্ষেপে উঠল। তারা বলল, মেয়েরা পুরুষদের কাজের পথ বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েরা যে পুলিশের কাছে  যাবে তা তারা ভাবেনি। ভারতের একটি অনগ্রর গ্রামীণ সমাজে এ এক অসম্ভব ঘটনা।
গীতা ছিল ছোটবেলা থেকেই ভীষণ রাগী। বালিকা বয়সেই ভাই-বোনরা তার খাবার কেড়ে নিলে সে ক্ষেপে গিয়ে সবার খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিত। তাদের কাজ বন্ধের কথা বলার পর ফুঁসে উঠল সেÑ তারা তাদের বউদের ঘরে বসিয়ে রাখুক, তারা তাদের ভাত রেঁধে খাওয়াক। আমরা কাজ করবই। আমাদের স্বামীরা আমাদের সাথে আছে।
গীতার বান্ধবী প্রেমবতী একটু বেশি হুঁশিয়ার। সে কোনো বেফাঁস মন্তব্য করে না। নাত সম্প্রদায়ের প্রথা হল যে সমাজ যদি কোনো মহিলাকে শাস্তি দেয় আর সে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চায় তাহলে তাকে আগুনে লাল হয়ে ওঠা একটি লোহার টুকরো হাতে নিয়ে মন্দিরের দিকে পাঁচ পা হেঁটে যেতে হবে। যদি তার হাত পুড়ে যায় তাহলে সে দোষী। তখন দোষ স্বীকার না করা পর্যন্ত তাকে একটি গর্তের মধ্যে ফেলে রাখা হবে।
একটি বিপজ্জনক এলাকায় তাদের বাস। সন্ধ্যা নেমে এলে প্রেমবতী তার কাদামাটির তৈরি চুলোর দিকে এগিয়ে যায়। রাতের আহারের রুটি তৈরি করে তাতে। তারা এত দরিদ্র যে দরজাওয়ালা ঘর তৈরির সাধ্য তার নেই। তাদের সম্বল হল দরজা জানালাহীন একটি খড়ের ঘর।
ভারতের শ্রম শক্তিতে মহিলাদের অংশ প্রায় ২৭ শতাংশ যা জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সউদি আরব ছাড়া অন্য সব দেশের চেয়ে সর্বনি¤œ। প্রচলিত মানদ-ে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ, শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও জন্মহার হ্রাস Ñ এ তিনের সমন্বয় ঘটলে ভারতের অর্থনীতিতে মহিলাদের দ্রুত সম্পৃক্ততা ঘটবে। তবে ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ভারতে বিপরীতটা ঘটে নারী কর্মীশক্তি ৩৭ শতাংশ থেকে ২৭ শতাংশে নেমে  এসেছে। এর প্রধান কারণ কর্মীশক্তি থেকে গ্রামীণ মহিলাদের বাদপড়া। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার জরিপ (আইএলও) অনুযায়ী ১৮৯টি দেশের মধ্যে নারী কর্মীশক্তি ক্ষেত্রে নিচের দিক দিয়ে ১৭ তম স্থানে রয়েছে ভারত।
বিশ^ বাজারের এক প্রতিযোগিতা মূলক উৎপাদক হিসেবে ভারতের জন্য এ এক খারাপ খবর। অর্থনীতিবিদরা এ জন্য দুটি তত্ত্ব খাড়া করেছেন। এক. ভারতের উন্নতি এমন একটি অংশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে যেখানে সাধারণত নারীদের প্রবেশাধিকার নেই। যেমন নির্মাণকাজ। দ্বিতীয় বিষয়টি সাংস্কৃতিক। নেহাত দুরবস্থার শিকার না হলে ভারতের নারীরা ঘরে বাইরে বের হতে চায় না।
নাত সম্প্রদায়ও এর ব্যতিক্রম নয়। তারা এখন এ সীমারেখা পেরোতে শুরু করেছে, তাই অনেক কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রেমবতী ও গীতা স্থানীয় ঋণদাতাদের হাতের মুঠি শিথিল করে দিচ্ছে, স্বাধীনতার স্বাদ তাদেরকে শক্তি দিয়েছে। এ ভাবে গত  বসন্ত ও গ্রীষ্মের পাঁচ মাসে অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার অদম্য শক্তিতে তারা সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অচলায়তনের মোকাবিলা করেছে।
তবে তারা আবিষ্কার করেছে যে কর্মীশক্তির অংশ থাকার মূল্য অতি উচ্চ।
একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে রুটি নিয়ে প্রতিদিন সকাল ১০টায় কজে যোগদানের জন্য বাড়ি থেকে বেরোয় গীতা ও প্রেমবতী। প্রচ- রোদ, পথের দু’পাশে ঘুরে বেড়ানো কুকুর ও মহিষের ভিতর দিয়ে পথ কেটে এগিয়ে যায় তারা।  তাদে বাড়ি থেকে মাংস কারখানায় যেতে অটোরিকশায় জনপ্রতি ভাড়া ৫ রুপি। এ সামান্য পরিমাণ অর্থ বাঁচাতে তারা হেঁটেই পাড়ি দেয় এ পথ। সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা। কারখানার চারপাশে মুসলমানদের বাস। সে এলাকার ভিতর দিয়ে যায় তারা। তখন মধ্যযুগীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী পর্দার বিকল্প হিসেবে দোপাট্টায় মাথা ও মুখ ঢেকে রাখে।       
পাঁচ বছর ধরে মিরাটে বেশ কিছু মাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানা গড়ে উঠেছে।  এখান থেকে হিমায়িত মহিষের মাংস রফতানি হয় সউদি আরব, মিসর ও চীনে। নীরবেই ভারত হয়ে উঠেছে বিশে^র বৃহত্তম মাংস রফতানিকারক। মিরাটে দিন দিন কারখানার আরো সম্প্রসারণ ঘটছে। পাঁচ বছর আগে এখানে কাজ শুরু করে গীতা ও তার বন্ধুরা। এভাবে তারা তাদের স্বামীদের আয়ের সাথে যোগ করেছে অতিরিক্ত অর্থ। বিয়ের মওসুমে বাদকদলের সদস্য হিসেবে তাদের স্বামীরা যা পায় সেই তাদের সারা বছরের উপার্জন। গীতারা মাংস কারখানার সীমানা দেয়ালের মধ্যে পাথর ভেঙে টুকরো করে এবং সিমেন্টের মিশ্রণবোঝাই অগভীর পাত্র বহন করে। কেউ কেউ মাংসের পাত্র ধোয়, কেউ কার্টন জোড়া দেয়, কেউ ইট বহন করে।  
গীতা ও প্রেমবতীর কাছে তাদের কাজ একঘেয়ে, ভীতিকরও বটে। তাদের সমাজে নারীদের জন্য নানা বিধিনিষেধ বিদ্যমান। কোনো বয়স্ক লোককে দেখলে তাদের উঠে দাঁড়াতে হয়, তারা চেয়ারে বা অন্য আসনে বসতে পারে না। সম্প্রদায়ের বাইরে চিকিৎসক ও চুড়ি বিক্রেতা ছাড়া আর কোনো পুরুষের স্পর্শ তাদের জন্য নিষিদ্ধ।  
তারা প্রথম যখন কাজ করতে যায তখন ভয় ছিল যে অপরিচিত লোকজন তাদের হাত ধরবে। এ ভয়ে গীতা খুব শঙ্কাগ্রস্ত ছিল। একবার কারখানায় কাজ করার সময় পা পিছলে সে ১০ ফুট গভীর একটি গর্তের মধ্যে পড়ে যায়। একজন মুসলিম কেরানি দৌড়ে এসে তাকে টেনে তোলার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেও সে তা এমনভাবে  প্রত্যাখ্যান করে যেন কোনো অপবিত্র বস্তু। প্রেমবতী এসে টেনে না তোলা পর্যন্ত গর্তের মধ্যেই পড়েছিল সে।  
তবে দিন যাওয়ার সাথে সাথে তাদের ভয়ও কেটে যায়। নির্মাণকাজে তারা নেপাল ও বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিক, চীন থেকে আসা ক্রেতা, বিএমডব্লিউ ও অডিসে চড়ে আসা কারখানা মালিকদের পুত্রদের দেখতে পায়। রাতে বাড়ি ফেরার সময় তারা তাদের ব্লাউজের ভিতর থেকে ঘামে ভেজা ভাঁজ করা টাকাগুলো হাতে নিয়ে দেখে। পূজা নামের এক মহিলা জানায়, এ টাকার কারণে তার স্বামী ও শাশুড়ি তাকে মারধর করা বন্ধ করেছে। সে বলে, যখন তুমি টাকা আয় করবে তখন তাদের কাছে তোমার দাম আছে। গীতার কাছে এখন এটা পরিষ্কার যে সে যে কারখানায় কাজ করে সেখানে যৌন নিপীড়নের সম্ভাবনা নেই। সে বলে, আপনি যখন কাজ শুরু করবেন তখন মনটা কাজে নিমগ্ন হয়ে যাবে। তখন আর ভয় থাকে না।   
কাজ ও রোজগার নারীদের মধ্যে পরিবর্তন সূচিত করেছে। গীতাসহ কর্মী মেয়েরা প্রতিদিন কারখানায় দু’বার সাবান ব্যবহার করে। প্রেমবতীর স্বামী মাতাল হয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় দড়ির খাটিয়ায় ঘুমিয়ে কাটায়। সে এখন বুঝতে পেরেছে যে তার পায়ের নিচের মাটি আর নরম নয়। নিজে আয় দিয়ে সে তিন সন্তানের বিয়ে দিয়েছে। এখন শেষ সন্তানটির একটি গতি হলেই সে দায়মুক্ত হতে পারে। সূত্র দি নিউ ইয়র্ক টাইমস। (অসমাপ্ত)      

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন