শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বন-পাহাড় উজাড়

পাল্টে যাচ্ছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভারসাম্য অপরূপ ভূ-প্রাকৃতিক মানচিত্র করোনার আতঙ্কে শুরুতে কয়েক মাস পরিবেশ-প্রকৃতিতে মানুষ ধ্বংসের হাত গুটিয়ে রাখে পাহাড় কেটে-খুঁড়ে দখল বনজসম্পদ লোপ

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

করোনাভাইরাস মহামারীর ভয়-আতঙ্কে প্রথম কয়েক মাস মানুষ নিজেদের স্বেচ্ছায় ঘরবন্দি করে রাখে। পরিবেশ-প্রকৃতির উপর ধ্বংসের হাত গুটিয়ে নেয়। প্রকৃতিরাজ্যে তা ছিল শাপে বর। তবে এহেন সুখ-স্বস্তি টেকেনি বেশিদিন। প্রাণঘাতী করোনার ছোবল শেষ হয়নি। তবুও লোভী মানুষের আগ্রাসী হাত করোনার চেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আবারও দা-কুঠার-করাতের আঘাতে বিরান হচ্ছে বন-জঙ্গল। কোদাল-শাবলের কোপে ক্ষতবিক্ষত পাহাড়-টিলা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় ঘটছে ধ্বংসকান্ড। বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। পাল্টে যাচ্ছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অপরূপ ভূ-প্রাকৃতিক মানচিত্র। দুর্যোগপ্রবণ চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক ভারসাম্য হচ্ছে বিপন্ন।

করোনাভীতি আর শাটডাউন, লকডাউনের সুবাদে গাছপালা, বনজসম্পদ ধ্বংসের কবল থেকে প্রায় অক্ষত ও সুরক্ষা পায়। এরফলে বিগত এপ্রিল মাস থেকে জুন-জুলাই পর্যন্ত গাঢ়-ঘন সবুজ পত্র-পল্লবে বিকশিত বন-জঙ্গল। প্রকৃতির আপন নিয়মে-যত্মে প্রাণময় সজীবতায় বেড়ে উঠে বন আর বন্য প্রাণিজগত। বৃক্ষহীন ন্যাড়া পাহাড়-টিলাগুলো সবুজ বন-বাদাড়ে ছেয়ে যায়। করোনার অপর পিঠে সবুজ-সতেজ প্রকৃতিরাজ্যে উৎসবের মেলা বসে। মানুষের হাতের ছোঁয়া যত্ম-আত্তি ছাড়াই সবুজ প্রকৃতি আপন নিয়মে সৌন্দর্য-সৌকর্য মেলে ধরে। দূষণমুক্ত পরিবেশে বৃক্ষরাজি অক্সিজেন জোগান দেয় অফুরান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত কয়েক মাস ধরেই চট্টগ্রাম অঞ্চলে বনভূমি সাবাড় করছে বিভিন্ন এলাকায় সংঘবদ্ধ সেই পুরনো একেকটি চক্র। বন্দরনগরী ও জেলা চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার ও তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি মিলিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সর্বত্র এখন ধ্বংসলীলার একই দৃশ্য। বন-জঙ্গলের ভেতরে ও আশপাশে আইনত দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা করাত কলগুলো (স’মিল) আবারও জমজমাট। অবাধে বৃক্ষ নিধনের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে মালিকরা। ইট ভাটাগুলোতে কয়লার বদলে প্রতিদিনই পুড়ছে অজস্র পরিমাণ কাঠ। তাছাড়া ট্রাকে ট্রলারে প্রতিদিনই পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকার কাঠ।

চট্টগ্রামের মীরসরাই, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, সীতাকুন্ড, হাটহাজারী, কক্সবাজার জেলার সদর এলাকা, টেকনাফ, উখিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী এবং তিন পার্বত্য জেলার প্রায় সর্বত্র বৃক্ষ নিধন ও বনজসম্পদ হরিলুট চলছে। করোনাকালে যে ব্যাপক সংখ্যক বৃক্ষরাজি নিরুপদ্রবে বেড়ে উঠেছিল সেগুলো এখন উজাড় হচ্ছে। বৃক্ষ নিধনের সঙ্গে সারি সারি পাহাড়-টিলা ধ্বংসযজ্ঞ চলছে অবাধে। বনজসম্পদ লোপাট ও পাহাড় কাটা-খোঁড়া ও জবরদখলের নেপথ্যে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট তৎপর। ঘুষ-বকশিশ, স্পিডমানি, বখরা হিসেবে দৈনিক হাতবদল হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শফিউল আলম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, করোনাকালে প্রথমদিকে মানুষ ঘরবন্দি থাকার ফলে বনজসম্পদ ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা পায়। বৃক্ষরাজি বিকাশ লাভ করে। কিন্তু এখন আবারও মানুষ আগ্রাসী হাতে ফিরে এসেছে। বৃক্ষ নিধনকারীদের চিহ্নিত করে আইনানুগ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থে বনায়ন জোরদার করার বিকল্প নেই।
বনজসম্পদ বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে পরিবেশ-প্রকৃতির প্রাণ হচ্ছে বন-জঙ্গল এবং পাহাড়-টিলারাশি। অপরিণামদর্শী মানুষের আগ্রাসী হাতে পাহাড় টিলা উঁচুনিচু ভূমি কেটে-খুঁড়ে সমতল করতে গিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের চরম সর্বনাশ হচ্ছে। বন-জঙ্গলে গত ১৫ বছরে ১২ থেকে ২০ প্রজাতির গাছপালা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিলুপ্তির পথে। বৃক্ষরাজি হ্রাসের সাথে হরেক প্রজাতির পাখ-পাখালি, জীবজন্তু, জীববৈচিত্র্যের বিচরণ ও বংশবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। এতে করে সামগ্রিক প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে।

অতীতে দেখা গেছে পাখিরা গাছে বিচরণকালে ফলমূল খেয়ে যে বিষ্ঠা ছড়িয়ে দিতো এতেই বট, অশ্বথ, আম-জামসহ বহু জাতের গাছপালা সৃজন হয়। মানুষের ছোঁয়া বা যত্ম ছাড়াই গাছগুলো বড় হয়ে ঘন বৃক্ষে আচ্ছাদিত হয় পাহাড়। গাছের শেকড়ে শক্ত হয় পাহাড়ের মাটি। অবাধে বৃক্ষ নিধনের কারণে এই সৃজন প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধের পথে।

করোনায় কয়েক মাস বন্ধ থাকলেও চট্টগ্রামের সুশোভিত পাহাড়-টিলাগুলো আবারও কেটে সাবাড় করছে সংঘবদ্ধ চক্র। ভূমির উপর পেরেকস্বরূপ পাহাড় টিলা শিলারাশি। আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি পাহাড় ভূ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য, ভূমিকম্পসহ দুর্যোগ থেকে রক্ষা করছে। নির্বিচারে সেই পাহাড়-টিলারাশি ধ্বংস করে লোভী মানুষেরা ডেকে আনছে মহাবিপদ। ভূমিগ্রাসীরা পাহাড়গুলো কেটে-খুঁড়ে-ছেঁটে সারি সারি বসতঘর তৈরি করে ভাড়া দিচ্ছে গরীব দিনমজুরদের কাছে। একেকটি আস্ত পাহাড় কেটে সমতল করে নির্মিত হচ্ছে পাকা ভবন। পাহাড় কেটে বালুমাটির ব্যবসাও জমজমাট। চট্টগ্রামে এখন আর কোনো পাহাড় অক্ষত খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বর্ষায় মহানগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে ভূমিদস্যুরা পাহাড় কেটে-খুঁড়ে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ফেলে রাখে। বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়-টিলার ভাঙা অংশে বা ফাটলে পানি ঢুকে মাটির ধস নামে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় পাহাড়। বর্ষা শেষে পাহাড় দখল করে অবৈধ বাড়িঘর তৈরির মহোৎসব শুরু হয়।

ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়গুলোর ভৌগোলিক ও ভূ-প্রাকৃতিক গঠন গড়ন শক্তিশালী নয়। এখানে পাহাড় প্রধানত বালুমাটির। এক থেকে দেড় ফুট নিচেই বালুর লেয়ার রয়েছে। যা নরম ও শিথিল। বর্ষায় বৃষ্টির পানি ভাঙা বা কাটা পাহাড়ের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই ব্লক আকারে পাহাড়ধসের কারণে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে। পাহাড়ধসে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে হলে যার পাহাড় তাকে দায়-দায়িত্ব নিয়ে সুরক্ষা করতে হবে।

পাহাড় রক্ষায় সরকারি উদ্যোগে গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির দু’জন ভূ তত্ত্ব ও পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম ও অধ্যাপক আবদুল হকের অভিমত, ‘পাহাড়কে পাহাড়ের মতোই থাকতে দিতে হবে। পাহাড়ের সম্পদ-সম্ভাবনাকে সুষ্ঠু পরিকল্পনা সহকারে দেশ ও জাতির স্বার্থে কাজে লাগাতে হবে’।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Dildar Chowdhury Hira ৮ অক্টোবর, ২০২০, ১:২৬ এএম says : 0
বনজসম্পদ ধ্বংস ও পাহাড় টিলাভূমি বেদখলকারীরা দেশের শত্রু দশের শত্রু। এদেরকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। বনজঙ্গল এবং পাহাড় রক্ষার জন্য সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণ করাই সময়ের দাবি। নচেৎ পাহাড় জঙ্গল নিঃশেষ হতে বেশিদিন নেই।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন