সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

চীনা নাগরিক হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে

সৈয়দ ইবনে রহমত | প্রকাশের সময় : ৯ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৯ এএম

গত ৭ অক্টোবর পিরোজপুরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুতে কর্মরত একজন চীনা নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তির নাম লাও ফাং (৫৮)। নিহত চীনা নাগরিক লাও ফাং কচা নদীর ওপর নির্মাণাধীন অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ১৭ ব্যুরো গ্রুপ লিমিটেডের সাব-কনট্রাক্টর ও প্রধান টেকনিশিয়ান ছিলেন। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে লাও ফাং নির্মাণাধীন সেতু এলাকায় থাকা তার আবাসস্থল থেকে শ্রমিকদের শেডে যাচ্ছিলেন শ্রমিকদের বেতনের টাকা নিয়ে। এসময় দুর্বৃত্তরা তার বুকের ডান পাশে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করে টাকাগুলো ছিনিয়ে নেয়। সেখান থেকে স্থানীয়রা লাও ফাংকে উদ্ধার করে পিরোজপুর জেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। প্রাথমিকভাবে একে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা বলেই ধারণা করছেন অনেকে। লাও ফাংয়ের সঙ্গে থাকা শ্রমিকদের বেতনের টাকা খোয়া যাওয়াতে এ যুক্তিটাই সামনে এসেছে। কিন্তু বিষয়টা এতটা সরলীকরণ করে দেখা কতটা সমীচীন সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। চীন আমাদের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী দেশ। ৪৫ বছর পূর্বে বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে আজ পর্যন্ত চীন সরকার চায়না এইড কাঠামোর আওতায় বাংলাদেশে আটটি সেতু নির্মাণ করেছে। এগুলো সব বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, রাজধানী ঢাকা থেকে যেকোনো শহরেই যাওয়া যাক না কেন অবশ্যই কোনো না কোনো বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু পার হতে হবে। এর মধ্যে অষ্টম সেতুটি পিরোজপুরের কচা নদীর দুই পাড়কে সংযুক্ত করবে, যার মাধ্যমে যাত্রীরা সরাসরি সড়কপথে বরিশাল ও খুলনায় যেতে পারবে এবং সেতুটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এন-৭ এবং এন-৮ মহাসড়কের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে। এ সকল বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু কেবল সেতুর দুই পাড়ের জনসাধারণের জন্য নির্ভরযোগ্য যাতায়াত-ব্যবস্থাই নিশ্চিত করেনি বরং চীন এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন বিনির্মাণ করেছে। এখন লাও ফাংয়ের মৃত্যুতে এ প্রকল্পটি সময় মতো শেষ হবে কিনা সেটি নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হলো।

আর আমাদের প্রতিবেশী দেশসহ অনেকেই আছে, যারা পছন্দ করছে না বাংলাদেশের পাশে থেকে চীনের অব্যাহত এ উন্নয়ন সহযোগিতাকে। বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই, থাকলেও তারা এদেশ এবং এদেশের জনগণের উন্নয়নে ততটা উদার হতে নারাজ। কিন্তু চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাক, সেটাকেও তারা সহ্য করতে পারছে না। আর এসব আজকাল কোনো গোপন বিষয় নয়, বরং প্রকাশ্যে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ফোরামে এ বিষয়ে আলোচিত হচ্ছে। এরই মধ্যে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন চীনা নাগরিক হতাহতের শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে গত বছরের ডিসেম্বরে বনানীতে চীনা নাগরিক গাও জিয়াং হুই(৪৭) কে হত্যা করা হয়েছিল, তার আগে জুন মাসে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে শ্রমিকদের সংঘর্ষে চীনা নাগরিক ঝাং ইয়াং ফাং (২৬)-এর মৃত্যু এবং একই ঘটনায় বেশ কয়েকজন চীনা শ্রমিক আহত হন। এখন আবার পিরোজপুরে ঘটল লাও ফাংয়ের মৃত্যুর ঘটনা। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও পেছনে অন্যকোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা সেটিও পরখ করে দেখা প্রয়োজন। প্রয়োজন ঘটনার আগা-গোড়া উদ্গাঘটন করে দায়ীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা।

এর আগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীতে এক ইতালীয় নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল, কয়েকদিন পরেই রংপুরে হত্যা করা হয় এক জাপানি নাগরিককে। আর হোলি আর্টিজানের ঘটনাতেও ৭ জন জাপানি এবং ৯ জন ইতালীয় নাগরিক হত্যার শিকার হয়েছিলেন। এসব ঘটনা বন্ধুপ্রতিম দেশের নাগরিকদের মনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করতে পারে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোরও তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক না। যদিও এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে সেটা দেখা যায়নি। কিন্তু আমারা যদি তাদের যথাযথ নিরাপত্তা দিতে না পারি তাহলে তারা তাদের জীবনের শঙ্কা নিয়ে আর কতদিন আমাদের পাশে থাকার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবেন সেটা নিয়েও ভাবনার অবকাশ আছে।

পিরোজপুরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুতে কর্মরত চীনা নাগরিক লাও ফাংয়ের হত্যাকান্ড অত্যন্ত দুঃখজনক ও মর্মস্পর্শী। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগসহ সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্পগুলোতে চীনা বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় চীনা নাগরিক হত্যার ঘটনাকে সাধারণ ছিনতাই বা নিছক হত্যার ঘটনা হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে, গত বছরের জুনে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে গুজব ছড়িয়ে সৃষ্ট হামলায় চীনা নাগরিক ঝাং ইয়াং ফাং (২৬)’র মৃত্যুর পর প্রায় উদ্বোধন হতে যাওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ বেশ কিছুদিন বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। সে ঘটনাকেও সাবোট্যাজ বা অন্তর্ঘাত বলে মনে করেছিলেন অনেকে। বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি এবং চীনা বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতেই এমনটা করা হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। লাও ফাংয়ের হত্যার ঘটনাতেও একই ধারণা পোষণ করছেন কেউ কেউ।

নিরাপত্তা, শান্তি ও স্থিতিশীলতার মাধ্যমে আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করা বিনিয়োগ ও উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। বিদেশিরা নিরাপত্তা না পেলে বা যখন তখন আক্রান্ত হলে সে আস্থার পরিবেশ বিঘ্নিত হতে বাধ্য। তাছাড়া একটি নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারী চক্র বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি ও সন্ত্রাসী চক্রের চারণভূমি হিসেবে প্রমাণ করতে অনেক দিন ধরেই অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ও স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে এটি একটি অনেক বড় চক্রান্তের অংশ। উল্লেখ্য, হোলি আর্টিজান হামলায় নিহত জাপানি প্রকৌশলীরা মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে কাজ করছিলেন। আর ইতালীয়রা বেশিরভাগই ছিলেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী। হোলি আর্টিজান হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে জাপানি উন্নয়ন সহযোগিতা এবং গার্মেন্ট ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিলেও ইতোমধ্যে তার উত্তরণ ঘটেছে। উপমহাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় চীনের বিনিয়োগ আমাদের জন্য বিকল্পহীন অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে। চীনের বিনিয়োগ ও সহযোগিতায় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বহুদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের চাকায় নতুন গতি সঞ্চারিত হয়েছে। চীনা নাগরিক হত্যা করে এবং চীনা বিনিয়োগে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে গোলযোগ সৃষ্টি করে কোনো পক্ষ যদি বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সহযোগিতার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চায়, তবে তা অবশ্যই নস্যাৎ করে দিতে হবে। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। উপযুক্ত তদন্ত এবং দ্রুত বিচারের মাধ্যমে চীনা নাগরিক লাও ফাংয়ের হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভ্রমণসস বিভিন্ন কারণে দেশে অবস্থান করা বিদেশি প্রতিটি নাগরিকের যথাযথ নিরাপত্তা বিধান আমাদের নিজেদের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার স্বার্থেই করতে হবে।
sayedibnrahmat@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (13)
বান্নাহ ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৩:২১ এএম says : 0
আমি লেখকের সাথে সম্পূর্ণ একমত
Total Reply(0)
বান্নাহ ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৩:২২ এএম says : 0
সবার আগে এই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে
Total Reply(0)
এনায়েতুল্লাহ ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৩:২৩ এএম says : 0
বর্তমান সময়ে এই ধরনের ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য হুমকি
Total Reply(0)
পায়েল ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৩:২৪ এএম says : 0
উপযুক্ত তদন্ত এবং দ্রুত বিচারের মাধ্যমে চীনা নাগরিক লাও ফাংয়ের হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
Total Reply(0)
সবুজ ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৩:৫০ এএম says : 0
এসব ঘটনার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও পেছনে অন্যকোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, কোনো ষড়যন্ত্র আছে কিনা সেটিও পরখ করে দেখা প্রয়োজন।
Total Reply(0)
আরমান ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৩:৫১ এএম says : 0
একটি নেপথ্য ষড়যন্ত্রকারী চক্র বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি ও সন্ত্রাসী চক্রের চারণভূমি হিসেবে প্রমাণ করতে অনেক দিন ধরেই অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এটা তাদের কাজ হতে পারে
Total Reply(0)
Robin Ahmed ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৭:৩৪ এএম says : 0
Kader dara hoy seta desher jonogon jane.
Total Reply(0)
Md Nasir Uddin ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৭:৩৪ এএম says : 1
এটা ভারতের কাজ। কারন সব সন্তাসী কাজে ভারতের হাত রয়েছে।
Total Reply(0)
Rafiqul Islam Khan ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৭:৩৫ এএম says : 1
অামি নিশ্চিত করে বলতে পারি ভারত এই কাজ করছে যাতে করে চিনাদের সাথে পরকীয়া না করা যায়।
Total Reply(0)
আকবর সোহেল রানা ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৭:৩৫ এএম says : 0
আমার মনে হয় চিনা হত্যা পরিকল্পনা ভারতে দালারদের হাত আছে,জাতে করে চিন সাথে আমাদের সমপ্ক মনমালিন্য হয়, তাই সবাই কে সতর্ক থাকতে হবে ভবিষ্যতে এরকম হত্যা কান্ড যেনো না হয়।
Total Reply(0)
Mahmud Sheikh ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৭:৩৫ এএম says : 0
এটা আমাদের জন্য অপূরনীয় ক্ষতি
Total Reply(0)
MD Imran Hossain ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৭:৩৫ এএম says : 0
এইটা ইসকন সদস্যদের কাজ যাতে করে চীন এই দেশে বিনয়োগ না করে বাংলাদেশ কে ভারতের দারস্থ হতে হয়।
Total Reply(0)
Sajid ৯ অক্টোবর, ২০২০, ৮:৩৬ পিএম says : 0
Extremely worried! Alas, Bangladesh! When will you wake up?
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন