বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বন-পাহাড় রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৯ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৯ এএম

করোনাভাইসের প্রাণঘাতী মহামারি এই মুহূর্তে বিশ্বের এক নম্বর সংকট হিসেবে গণ্য হলেও গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। ঘনবসতিপূর্ণ নদীবিধৌত ব-দ্বীপ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উপর জলবায়ুর পরিবর্তনের খড়গ অনেক বেশি আগ্রাসী হতে পারে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং পরিবেশবিদদের পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। যদিও উষ্ণায়নের জন্য আমাদের মত অনুন্নত দেশগুলো দায়ী নয়, তথাপি এর প্রভাব আমাদের উপরই সবচেয়ে বেশি পড়ছে। ঝলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কয়েকফুট বেড়ে গেলে আমাদের দেশের দক্ষিণের কয়েক কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিনত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় বৈশ্বিক ইনিশিয়েটিভের পাশাপাশি প্রত্যেক দেশকেই পরিবেশগত সুরক্ষা, জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় নিজস্ব কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নজর দিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গৃহিত নীতিগত উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু এসব পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। বিশেষত দেশের নদনদীগুলোর ভয়াবহ দূষণ- দখল, জলাভূমি, বনভূমি ও পাহাড়-পর্বত রক্ষার উদ্যোগগুলো কাগজে-কলমে থাকলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।

নদনদী, হাওর-বাওর, বিশাল সমতলভূমি, সীমিত বনভূমি ও পাহাড় মিলে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র গড়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে আবাসন, শিল্পায়ন ও অবকাঠামোখাতে ফসলি জমি দ্রুত কমে যাচ্ছে। আইনগত বৈধতা ছাড়াই একইভাবে পাল্লা দিয়ে কমে যাচ্ছে বনভূমি এবং পাহাড়ের স্বাভাবিক পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে করোনাকালীন লকডাউন কিছুটা শিথিল হওয়ার পর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড় টিলাগুলোতে পাহাড় খেকো ও বনদস্যুদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে। করোনাকালে প্রায় সব ধরণের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ার পাশাপাশি দস্যুতা, দখলবাজি ও পরিবেশগত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধের একটি ইতিবাচক আবহ দেখা গেছে সর্বত্র। তখন ধূলোমুক্ত পরিষ্কার আকাশে শত কিলোমিটার দূরের হিমালয় পর্বত দৃশ্যমান হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। করোনা সংক্রমনের হার এবং আশঙ্কা থেকে এখনো মুক্ত হতে না পারলেও কিছু মানুষ এখন আগের মত দখলবাজি ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নদ-নদীর দখলবাজদের পাশাপাশি পাহাড় ও বনভূমি ধ্বংসের হোতারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেই পুরনো সংঘবদ্ধ চক্রটি এখন নতুন উদ্যমে পাহাড় ও বনভূমি উজাড় করে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিশেষ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে প্রশাসনের চোখের সামনেই বছরের পর বছর ধরে চলছে অবৈধ করাতকলগুলো। অবৈধভাবে বনের গাছ কেটে চেরাই করে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হলেও বনবিভাগ, পরিবেশ অধিদফতর বা স্থানীয় প্রশাসনের যেন কিছুই করণীয় নেই।

মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের বিশ্বকে সমুদ্র, নদনদী, পাহাড়, বনভূমি ও আকাশ মন্ডলি দ্বারা সুসজ্জিত ও সুরক্ষিত করেছেন। পবিত্র কোরানের একাধিক আয়াতে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি মানুষ ও প্রাণীজগতের সুরক্ষার জন্য পাহাড়-পর্বতের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক বিশ্ববাস্তবতার আলোকে এটা এখন দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশগত ভারসাম্য সুরক্ষা এবং বাসযোগ্য আবাসভূমির নিরিাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও নির্দেশনায় কৃষিজমি সুরক্ষার বিষয়ে বেশকিছু কার্যকর উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও বন ও পাহাড় ধ্বংসের হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। প্রতিটি সেক্টরের দখলবাজ, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা দৃশ্যমান না হওয়ার কারণেই প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় কথিত সংঘবদ্ধ চক্র বেপরোয়া হয়ে বন ও পাহাড়ে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি টিলা কেটে মাটি বিক্রি করে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার ভাগাভাগি হচ্ছে। এর ফলে সবুজ পাহাড়গুলো ধূলোময়- মরুময় হয়ে যাচ্ছে। এসব এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনায় প্রতিবছরই প্রাণহানি ঘটছে। এই প্রেক্ষাপটে পাহাড়খেকো ও বনখেকোদের বিরুদ্ধে জিরোটলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। বন ও পাহাড় ধ্বংসে লিপ্ত সংঘবদ্ধ চক্রের সাথে যে বনবিভাগ, প্রশাসন ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদেরকে আইনগত জবাবদিহিতা ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে দেশের হাওরাঞ্চলে উন্নয়নের মাইলফলক প্রকল্প হিসেবে আবুরা সড়ক বা অল ওয়েদার রোড নিমার্ণ করেছে। হাওড়ের পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সেখানকার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সুফল নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগ বিশাল ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। একইভাবে দেশের বনভূমি ও পাবর্ত্য এলাকার নিরাপত্তার পাশাপাশি পর্যটন ও কৃষি উৎপাদনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিশ্চিত করার যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন