বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

মানবাধিকার ও ইসলাম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ৯ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৯ এএম

বারো
৮। গণতান্ত্রিক অধিকারের গোড়াপত্তন : মত প্রকাশের অধিকার, প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার, ন্যায়সঙ্গতভাবে সরকারের সমালোচনা করার অধিকার ইসলামে স্বীকৃত। এ প্রসঙ্গে একটি প্রসিদ্ধ ঘটনার উদ্ধৃতি দেয়া যায়। উমরা রা. এর খিলাফতকালে খলীফা জুমুআর খুতবা মিম্বরে দাঁড়ানোর সাথে সাথে এক মুসল্লী জানতে চাইলেন খলীফার জামা এত লম্বা হলো কীভাবে? কারণ বায়তুলমাল থেকে সকলকে যে কাপড় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা দিয়ে এতো লম্বা জামা বানানো যায় না। প্রশ্নকর্তা যখন জানলেন, খলীফার ছেলের ভাগে যে কাপড় পাওয়া গেছে সেটা খলীফাকে দেয়ার ফলেই তাঁর পক্ষে লম্বা জামা বানানো সম্ভব হয়েছে তখন প্রশ্নকর্তা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, হ্যাঁ এখন খুতবা শুরু করুন। আমরা শুনবো। খলীফা বললেন, যদি সন্তোষজনক জবাব না পেতে তাহলে কী করতে? তখন প্রশ্নকর্তা বললেন : তখন আমার এই তলোয়ার এর সমাধান দিতে! একথা শুনে খুশী হয়ে খলীফা বললেন- হে আল্লাহ্ ! যতদিন পর্যন্ত এরূপ সাচ্চা ঈমানদার বান্দা জীবিত থাকবে ততদিন ইসলাম ও মুসলমানের কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। “রহমান, মুহম্মদ মতিউর, পৃ. ৩৬”।
৯। ন্যায়বিচার লাভের অধিকার : মুহাম্মদ সা. প্রবর্তিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক-সামাজিক-পেশাগত মর্যাদা নির্বিশেষে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক একটি নিরপেক্ষ, অবাধ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার অধীনে স্বাভাবিক ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার লাভ করে। মূলত ন্যায়বিচার ধারণার উপর ইসলামে এতটা গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, কুরআনে প্রায় ষাটটি আয়াতে এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন একটি আয়াতে বলা হয়েছে “তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক এবং আল্লাহর জন্য ন্যায় সঙ্গত সাক্ষ্য দাও, তাতে যদি তোমাদের পিতা-মাতা কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের ক্ষতি হয় তবুও। “আল-কুরআন, ৪ : ১৩৫”। রাসূল সা. প্রতিষ্ঠিত শাসনামলে ইসলামের বিচারব্যবস্থা যা শাসক গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপ মুক্ত, স্বাধীন, অবাধ ও নিরপেক্ষ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে, তা ছিল মূলত রাসূল সা. এর মানবতাবোধ ও মানবাধিকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত। মনীষী বার্ক এ সম্পর্কে চমৎকারভাবে রাসূল সা. এর কৃতিত্বের স্বীকৃতি দিয়েছেন।
তাঁর ভাষায়- The Muhammedan Law is binding upon all, from the crowned head to the meanest subject. It is a aw interwoven with a system of the wisest, the most lerned and most enlightened jurisprudence that has ever existed in the world. সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ সা. : উল্লেখিত ক্ষেত্রগুলোর পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজ ও মানবিকতার ক্ষেত্রে হযরত মুহাম্মদ সা. যে অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন তা মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এমনকতগুলো ক্ষেত্র এখানে আলোচনার দাবী রাখে।
১। শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় রাসূল সা. এর বাস্তবমুখী পদক্ষেপ : কুরআনে আল্লাহ্ স্পষ্ট ভাষায় মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন, “আমি তোমাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্যে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি”। “আল-কুরআন, ২১ : ১০৭”। কুরআনের এ বাণী পরিপূর্ণভাবে সত্যে পরিণত করেছিলেন রাসুল সা.। সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র মানব জাতির ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অনন্য উদাহরণ রেখে গেছে পৃথিবীর ইতিহাসে তা আজো অদ্বিতীয় ও অনুকরণীয়। কেননা তিনি কেবল মুসলমানদের আদর্শ ছিলেন না, ছিলেন গোটা মানব জাতির আদর্শ। আল্লাহ্ তা’য়ালা তাঁকে এই মর্মে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন- “বলুন, হে মানবজাতি, আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রাসূল। “আল-কুরআন, ৭ : ১৫৮”।
মুহাম্মদ সা. ছিলেন সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব যিনি অতি শৈশবে বিস্ময়করভাবে সমবণ্টন নীতিতে তার দুধ মা হালিমার ঘরে দুধ মাতার একটি মাত্র স্তন পান করতেন আর একটি রেখে দিতেন হালিমার নিজের সন্তানের জন্যে। “কায়্যূম, অধ্যাপক হাসান আব্দুল, শাস্তির দুত হযরত সা. সীরাত স্মরণিকা, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৪১৫, পৃ. ৩৮”।
সমগ্র মক্কাবাসী যখন তাদের দ্বারা নির্যাতিত, বিতাড়িত, চরম প্রতিহিংসার শিকার মুহাম্মদ সা. এর হাতে চরম দন্ড পাওয়ার আশংকায় প্রহর গুণছিল, সেদিন শান্তির দূত মুহাম্মদ সা. নিঃশর্ত ক্ষমা করে দয়া ও ক্ষমার অপার মহিমান্বিত ইতিহাস রচনা করেন। ঐতিহাসিক গিবনের ভাষায় বলা যায়- In the long history of the world there is no instance of mangnamity and forgiveness which can approach those of Muhammad (s) when all his enemies lay at his feet and he forgave them one and all. “প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০”।
২। দয়া, ক্ষমা ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূল সা. এর অনন্য পদক্ষেপ : মহানবী সা. ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু, ক্ষমাশীল ও কোমল। দয়া, ক্ষমা, শান্তিও সাম্যের প্রতিরূপ এই মহামানব স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, “যে মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহ্ তাকে দয়া করেন না। “রহমান, শেখ ফজলুর, সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা. সীরাতুন্নবী সা. স্মরণীয়, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৪০৭, পৃ, ১৮”। এখানে কেবল মুসলমানদের কথাই নয় বরং সমগ্র সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শনকে তিনি নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। অন্য একটি হাদীসে মহানবী সা. বলেন : “পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া কর। ঊর্ধ্বলোকে যারা আছেন তারাা তোমার প্রতি সদয় হবেন”। “রহমান, শেখ ফজলুর, প্রাগুক্ত পৃ. ১৯”। অন্যদিকে শ্রমিক, অধীনস্থ কর্মচারী ও চাকর-চাকরানীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা, তাদেরকে নিজেদের অনুরূপ, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, বিশ্রাম ইত্যাদির ব্যবস্থা করতেও তিনি বার বার তাগিদ দিয়েছেন। বস্তুত বিশ্বনবী সা. শ্রমিকদের সব প্রকার বঞ্চনা, অত্যাচার, নিপীড়ন আর গ্লানির অবসান করে এমন সব শ্রমনীতির প্রবর্তন করে গেছেন যার সিকি শতাংশও জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রসংস্থা (আই.এল.ও) বিগত ১১৮ বছর ধরে মে দিবস উদ্যাপনের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। “হোসেন, মুহাম্মদ ফরহাদ, মে দিবস, শ্রমিক শ্রেণী এবং ইসলাম, দৈনিক যুগান্তর, ৩০ এপ্রিল, ২০০৪, পৃ. ১২”।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন