শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

জলবায়ু পরিবর্তন: অভিযোজনমূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১১ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৫ এএম

আমাদের উন্নয়নের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে: খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, দেশের সকল নাগরিকের জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন। বলা বাহুল্য, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার পথে এক বিরাট বাধা ও প্রতিবন্ধক হয়ে আছে।

জলবায়ু পরিবর্তন সকল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেই সমানভাবে আঘাত হানবে। তবে আর্থিক এবং কারিগরী সমতার জন্য উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে এর প্রভাব বিভিন্ন মাত্রায় অনূভত হবে। জলবায়ু পরিবর্তেনের প্রভাবে কোথাও দেখা দেবে অনাবৃষ্টি এবং খরা, আবার কোনো অঞ্চলে দেখা দেবে প্রবল বৃষ্টি ও বন্যা। কোথাও সাইক্লোন ও টর্নেডোর সংখ্যা বাড়বে আবার কোথাও তাপমাত্রার তারতম্য বেশি অনুভূত হবে। Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC) এর মতে, হিমালয় পর্বতের বরফ গলার ফলে, স্বল্প মেয়াদে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষত ব-দীপ অঞ্চলে বন্যার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাবে এবং ২/৩ দশকের মধ্যে হিমালয়ের হিমবাহ ক্ষীণ হয়ে স্বল্প পরিমাণ পানি সরবরাহের ফলে নদীতে পানিস্বল্পতা দেখা দেবে। সুপেয় পানির লভ্যতা বড় নদীর মোহনায় হ্রাস পাওয়ার ব্যাপক আশংকা রয়েছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাসমূহ বিশেষতঃ জনবহুল দ্বীপসমূহ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে সৃষ্ট বন্যা এবং বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।

১৯৮০-এর দশকে বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্তে মানবজাতির কর্মকান্ডের সাথে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে বিশেজ্ঞদের ধারণা সুদৃঢ় হয়। গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ ভূমন্ডলীয় জলবায়ুর পরিবর্তনকে প্রভাবিত করছে, এ ধারণা থেকে সচেতন মহল এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯০ সালে Intergovernmentel Negotiating Committee (INC) গঠন করে। INC, United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCC)-এর খসড়া তৈরি করে এবং ১৯৯২ সালে তা ব্রাজিলের রিওডি জেনোরোতে ধরিত্রী সম্মেলনে গৃহীত হয়। এই কনভেশনে গ্রিন হাউজ গ্যাস উদগীরণের জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে দায়ী করা হয় এবং সমস্যা সমধানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে দায়ী করা হয় এবং সমস্যা সমাধানে উন্নত বিশ্বকেই এগিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উল্লেখিত হয়। কনভেনশনে ২০০০ সালের মধ্যে সকল শিল্পোন্নত দেশকে ১৯৯০ সালের তুলনায় গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনতে হবে মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাদেশে উক্ত কনভেশনে ১৯৯২ সালে স্বাক্ষর করে এবং ১৯৯৪ সালে তা রেটিফাই করে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সারা বিশ্বের সাথে একত্রে কাজ করতে বাংলাদেশও অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং সীমিত ইউএনএফসিসিসি এর সকল সমঝোতা বিষয়ক মিটিং দাবি জানিয়ে আসছে। এছাড়া দেশেও বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের সাথে অগ্রাধিকারমূলক অভিযোজন কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে ২০০৫ সালে National Adaptation Programme of Action (NAPA) প্রণয়ন করেছে। নাপা’র আওতায় বাংলাদেশ ১৫টি অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প Community Based Coastal Afforestation Project বাস্তবায়নের জন্য UNFCCC থেকে ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। বন অধিদপ্তর কর্তৃক ইতিমধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

যুক্তরাজ্যের, আর্ন্তজাতিক উন্নয়ন দপ্তরের (DFID) সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরে একটি Climate Change Cell গঠন করেছে। এই সেলের মূল কাজ হচ্ছে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিষয়টিকে সম্পৃক্ত করা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, বিশেষতঃ পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেও সেল কাজ করছে। এছাড়া সেল জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম এবং মডেলিং কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ সরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে Bangladesh Climate Change Strategy and Action Plan (BCCSAP) প্রণয়ন করেছে। BCCSAP-তে ৬টি বিষয়ের আওতায় প্রায় ৪০টি কার্যক্রম চিহ্নিত করা হয়েছে। ভবিষ্যত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজন কার্যক্রম মোকাবেলায় সরকার তার নিজস্ব তহবিল হতে ৩০০ কোটি টাকার একটি জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল (Climate Change Found) গঠন করেছে। BCCSAP-তে চিহ্নিত ৬টি বিষয়ের আওতায় চিহ্নিত কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়ানে উক্ত অর্থ ব্যয় করা হবে। এ ধরনের Strategy and Action Plan বিশ্বের খুব কম সংখ্যক দেশই প্রণয়ন করেছে। তাছাড়া, উন্নয়নশীল দেশসমূহে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য নিজস্ব তহবিল গঠনও একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। আশা করা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস হতে অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এটি নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে যে বিশাল অভিযোজনমূলক কার্যক্রম গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে তার তুলনায় আমাদের নিজস্ব বরাদ্দ অথবা আর্ন্তজাতিক অর্থ প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিতান্তই অপ্রতুল। আমাদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনমূলক কার্যক্রমকে অবশ্যই আমাদের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন