শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

এ যেন আরেক কারবালা!

মোঃ শিবলী নোমানী ইবনে সাদেক খান | প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

প্রতিটি মানুষের জীবনেই কারবালা আসতে পারে। কারবালা একটি ঐতিহাসিক জায়গার নাম, এই জায়াগায় কি ঘটনা ঘটেছিলো? তা আমরা কম-বেশি সকলেই জানি। কারণ ইমাম হুসাইন (রা:) এবং তাঁর ৭১ জন সঙ্গী-সাথির সাথে ঘটে যাওয়া নির্মম ও নিষ্ঠুর ঘটনা লিপিবদ্ধ করার জন্য কোটি-কোটি লোক পূর্বেও ছিলো এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের সাথে ঘটে যাওয়া কারবালা কে মনে রাখবে? আবার কেই বা লিপিবদ্ধ করে রাখবে?
কারবালা একটি জায়গার নাম হলেও কারবালা মূলত একটি চেতনার নাম। যেই চেতনা আমাদের শিক্ষা দেয় অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করতে। পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হউক, জীবন যতই দূর্বিসহ হউক, প্রাণ যতই ওষ্ঠাগত হউক, ন্যায় ও নিষ্ঠার ব্যাপারে কোন প্রকার আপোষ করা চলবে না। গতকাল ছিলো মঙ্গলবার, আগস্ট মাসের ১৮-তারিখ আমি উপস্থিত ছিলাম আজিমপুর কবরস্থানে, আমার মামাতো ভাই শাবাব আহমেদ আলভির জানাজা উত্তর দাফন কার্যে। আমরা যখন দাফন কার্য সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হঠাৎ একটি কান্নার আওয়াজ আমাদের কানে ভেসে আসলো। সবার অনুসন্ধানি দৃষ্টি যাকে খুজে বের করল, সে আর কেউ নয়, আলভির ফুপাতো ভাই, ওর শৈশবের খেলার সাথি আলিফ। আমি বুঝে নিলাম আমার খালাতো ভাইয়ের বুক ফাটা আর্তোনাদের অন্তর নিহীত অর্থ।
শৈশব হলো জীবনের সবচাইতে আনন্দদায়ক সময় যে সকল ছেলে মেয়েরা তাদের শৈশবকে উপভোগ করতে পারেনি, তারা জীবনের অনেক বড় অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দারিদ্রতার জন্য যারা শৈশবকে উপভোগ করতে পারে না, তার দায় দায়িত্ব সমাজ অথবা রাষ্ট্রের উপর বর্তায় কিন্তু অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের ছেলে-মেয়েরা যখন পারিবারিক প্রতিকূলতার কারণে বন্ধু-বান্ধবহীন শৈশব কাটায় তখন তাদের মন মানসিকতায় একাকিত্বের ভুত চেপে বসে, পরবর্তীতে বাবা-মা যখন বুঝতে পারে তাদের সন্তান আত্নীয়-স্বজন দেখলে ভয় পায় অথবা কথা বলতে সংকোচ বোধ করে, তখন শত চেষ্টা করেও আর তাকে সামাজিকতা শিক্ষা দেওয়া যায় না। যাই হোক, আলিফ ও আলভি বয়সে কিছুটা ছোট বড় হলেও ওদের বেড়ে ওঠা একসাথে। সংগত কারণে আলিফ যখনই নিজের শৈশবে ফিরে যাবে তখনই ও আলভিকে মিস করবে। এমনকি কোন একদিন আলভির পিতা-মাতার কান্না থেমে যাবে, তাদের সন্তান হারানোর যন্ত্রনা হয়তো রয়ে যাবে কিন্তু আলিফ শৈশবের যেই খেলার সাথিকে হারিয়েছে সেটা ও কোন দিনই ভূলতে পারবে না।
এ পর্যায়ে মহানবী সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের মুহূর্তের কথা খুব মনে পড়ছে, মহানবী যখন হিজরত করার জন্য পবিত্র মক্কা নগরী থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন, তখন তিঁনি বার বার মক্কার দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাচ্ছিলেন, প্রশ্ন আসতে পারে কেন? কারণ তিঁনি তো স্বেচ্ছায় মক্কা ত্যাগ করেন নি, তিনি তো মহান আল্লাহপাকের নির্দেশকে বাস্তাবায়নের জন্য মদিনায় হিজরত করেন, সেইক্ষেত্রে তো তাঁর উৎফুল্ল থাকার কথা ছিলো? এই জাতীয় প্রশ্ন তারাই করবে যারা শৈশবকে উপভোগ করতে পারে নি। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় আমি এক কথায় উত্তর দেব মহানবীর শৈশব, মহানবীকে মক্কায় থেকে যাওয়ার জন্য চিৎকার করে ডাকতেছিলো।
শৈশব হলো জীবনের শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। তাই প্রত্যেক বাবা-মার উচিত তার সন্তানের শৈশবকে সম্মান করা। মহান আল্লাহ্পাক শৈশবের সময়কে এতটাই ভালোবাসেন যে, শরীয়তের যাবতীয় হুকুম-আহ্কাম থেকে শৈশবের সময়কে স্বাধীন করে দিয়েছেন অর্থাৎ তারুণ্যে পদার্পণের আগ পর্যন্ত শরীয়তের যাবতীয় হুকুম আহ্কাম থেকে শৈশব কাল একেবারেই মুক্ত। তবে ঈমানি তা’লিম তরবিয়ত অবশ্যই শৈশবে শিখাতে হবে। যেমনটি শিখেছিলো শাবাব আহমেদ আলভি। ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র হয়েও পারিবারিক ভাবে ইসলামী চিন্তা চেতনা, নামাজ-রোজা, কুরআন তেলাওয়াত সহ দোয়া-দুরুদে আলভি ও আলিফ ছিলো একে অপরের প্রতিদ্বন্দী। মাঝে একটা দীর্ঘ শূণ্যতা আলভি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য কানাডায় যাওয়ায় আলিফের একাকিত্ব শুরু হয়েছিলো আরো ৭, ৮ বছর পূর্বেই। আলিফ দেশেই ওর পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে সবেমাত্র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে। আর এরই মধ্যে আলভির চলে যাওয়া ওর চিন্তার জগতে একটি বিশাল ক্ষত সৃষ্টি করেছে, যা আমরা হয়ত কোন দিনই বুঝতে পারবো না! প্রশ্ন আসতে পারে কেন? তরতাজা একটি যুবক হঠাৎ প্রচন্ড গতির বাতাসের ধাক্কায় দূর্ঘটার শিকার হলো কানাডার মত একটি উন্নত রাষ্ট্রে?
বিশ্লেষকরা হয়তো বলবেন, দূর্ঘটনাতো দূর্ঘটনাই তাসে কানাডাতেই হউক অথবা কেমেরুনেই হউক। আমরা যেকোনো দূর্ঘটনার থেকে দূরে থাকতে চাই। আমরা আমাদের জীবনকে শান্তিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে চাই কিন্তু আমাদের এই চাওয়াকে পাওয়ায় পরিণত করতে সবচাইতে বড় বাধা হলো শয়তান। অর্থাৎ শয়তান প্রতিনিয়ত মানুষের জীবনকে দূর্বিসহ করে তোলার জন্য বিরামহীম শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কথা স্মরণ করতে পারি। ছোট্ট শিশু হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার বাবাকে বলেছিলেন, হে পিতা আমি স্বপ্ন দেখেছি ১১টা তারা এবং চন্দ্র, সূর্য একত্রিত হয়ে আমাকে সেজ্দা করছে। স্বপ্নের বিবরণ শুনে বণী ইসরাঈলের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম বলেছিলেন, হে আমার সন্তান তোমার এই স্বপ্নের বিবরণ তোমার ভাইদের নিকট প্রকাশ করো না, তাহলে তারা তোমার জন্য বিশেষ কোন ষড়যন্ত্র করবে। আর মনে রেখো, নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু । হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালামের এই বক্তব্যটি গোটা পৃথিবীর পিতার জন্য আদর্শ বক্তব্য। প্রশ্ন আসতে পারে কেন? আমি অল্প কথায় উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। প্রথমত সম্মানিত সকল নবী আলাইহিস সালামগণ যেমন ফেরেশতাদের স্বচক্ষে দেখতে পেতেন তেমন ইবলিশ শয়তান সহ সকল জ্বীন-শয়তানকেও দেখতে পেতেন, তাই তিঁনি যুক্তিসংগতভাবে বলেছেন, “নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু ”। দ্বিতীয়ত স্বপ্ন যত ভালো কিংবা মন্দ হোক, উপযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া প্রকাশ করা উচিত নয়। মহানবী যেহেতু শেষ নবী, তাই তিঁনি আমাদের শয়তান থেকে বেঁচে থাকার অনেক রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন। প্রথমত সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আকিকা সম্পন্ন করা পিতা-মাতার জন্য অত্যন্ত জরুরী। দ্বিতীয়ত সহী-শুদ্ধভাবে কুরআনুল কারীমের তেলাওয়াত শিক্ষা দেওয়া তার চেয়েও বেশী জরুরী। এ বিষয়ে কুরআন, হাদিসে অসংখ্য দিক-নির্দেশনা রয়েছে। আমি যে বিষয়টি বুঝাতে চাচ্ছি তা হচ্ছে, শয়তানের ক্রিয়াকলাপ অর্থাৎ যেহেতু আমরা প্রকাশ্যে শয়তানকে দেখতে পাইনা, তাই আমরা শয়তানকে নিয়ে খুব বেশী মাথাও ঘামাইনা। (চলবে)

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন