বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

গতিশীল হচ্ছে অর্থনীতি

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৭ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৬ এএম

বাঙালি জাতিকে তুলনা করা যায় রূপকথার ফিনিক্স পাখির সঙ্গে। ভস্মের মধ্য থেকে যে পাখি উড়াল দেওয়ার সক্ষমতা দেখায়। ১৯৭১ সালের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। ১ কোটি মানুষ দেশছাড়া হয়েছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ভয়ে। লাখ লাখ বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছিল দখলদাররা। দেশের রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কলকারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণের পর দেশে চাষাবাদের জন্য লাঙ্গল ও হালের বলদের অভাবে হাজার হাজার একর জমি অনাবাদি থেকে যায়। বাংলাদেশকে ব্যঙ্গ করে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অভিহিত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের গডফাদারের ভূমিকা পালনকারী একটি দেশের ক্ষমতাধর মন্ত্রী। কিন্তু বাংলাদেশ গত চার যুগে নিজেদের পুনরুত্থানের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে এ জাতি হারতে জানে না।

করোনাভাইরাস ও সিরিজ বন্যায় দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা দেখিয়েছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা পাড়ের সাহসী জাতি। করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্বের অনেক দেশই এখনো ঘুরে দাঁড়াতে না পারলেও বাংলাদেশ এ সংকট খুব ভালোভাবেই সামাল দিতে পেরেছে বলে মনে করে এডিবি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ খাতগুলোর উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় করোনাভাইরা-সজনিত ক্ষয়ক্ষতি তেমন বড় কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। যে কারণে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ইতিমধ্যে বাড়তে শুরু করেছে। রপ্তানি আয়েও সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। আমদানি ব্যয় কম হওয়ায় ও রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। দেশের কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক। মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়েই কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, আলু, পেঁয়াজ, সবজির মতো নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা চলছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেলেও বন্যার প্রভাব কেটে গেলে শাকসবজিসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের আবাসন খাত আবারও পুরনো অবস্থায় ফিরছে। এ সাফল্য সম্ভব হয়েছে দেশবাসীর দৃঢ় মনোবল ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে। এগিয়ে চলার পথে যা এ জাতির পাথেয় বলে বিবেচিত।

এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) নতুন সুখবর দিয়েছে। তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদন মতে, ২০২০ পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৮ ডলার। আর একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। এছাড়াও চলতি বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। আইএমএফের এই পূর্বাভাস ঠিক থাকলে ভারত মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও নেপালের থেকে সামান্য এগিয়ে থাকবে। সে হিসাবে শুধু ভারত নয়, বরং পাকিস্তান, নেপালের চেয়েও এগিয়ে থাকবে বাংলাদেশ। আইএমএফ গত মঙ্গলবার ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক (ডব্লিউইও) প্রকাশ করেছে। সেখানেই এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। মূলত করোনার এই সময়ে ভারতের অর্থনীতি বেশি মাত্রায় সংকুচিত হবে বলে আইএমএফ বলছে। সে তুলনায় বাংলাদেশে এবার ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে। এ কারণেই এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের সামনে।

যদিও, করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে সৃষ্ট বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাদশা বাংলাদেশের ওপরও প্রভাব ফেলবে, এমন আশঙ্কা অনেক আগেই প্রকাশ করেছিল বিশ্বব্যাংক। তবে করোনা মহামারির ধাক্কা সামাল দিতে সরকার এরই মধ্যে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা সঠিক পথেই আছে বলে মনে করছে তারা। আবার নতুন আশঙ্কার কথাও বলছে সংস্থাটি। তবে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস হচ্ছে, বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হলেও সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসতে পারে, সেই সঙ্গে উৎপাদন ও নির্মাণ খাতের কর্মীদের আয় কমে আসায় ভোগব্যয় বাড়ার সুযোগ থাকবে না। স্বল্প মেয়াদের জন্য হলেও দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়ে যেতে পারে। সংস্থাটি বলছে, কৃষির বাইরে বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের যে কর্মীরা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তাদেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হতে হবে। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ হচ্ছে, অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো যেন টেকসই হয়, সে জন্য সরকারকে আর্থিক খাত ও ঋণ ব্যবস্থাপনার স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে। আর্থিক খাতকে মজবুত করার দিকে নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসংশ্লিষ্ট কয়েক কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছে কিংবা পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে। আর বিশ্বের ১৬০টি দেশে থাকা এক কোটি প্রবাসীর মধ্যে করোনাকালে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন তিন লাখ কর্মী। করোনা দুর্যোগে বেকার হয়ে পড়া বিপুল এই জনসম্পদের কর্মসংস্থানে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি বড় প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রবাসীদের আয়ে ফিরিয়ে আনার এই প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় প্রবাসীরা চাইলে দেশের চাকরিতে প্রবেশ করতে পারবেন। উদ্যোক্তা হতে চাইলে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ ঋণসুবিধা দেওয়া হবে। আবার বিদেশে যেতে চাইলে আরো দক্ষ হয়ে উঠতে খাতভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। নতুন করে বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদেরও এই প্রকল্পের অধীন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ‘রিকভারি অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট অব ইনফরমাল সেক্টর এমপ্লয়মেন্ট বা রেইজ’ শীর্ষক এই প্রকল্পে এক লাখ লোকের চাকরির পাশাপাশি তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা হবে।

পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। দ্রুত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে অর্থনীতির চাকা গতিশীল থাকবে।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সদস্য, এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন