বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পররাষ্ট্রনীতিতে সঠিক পথেই আছে বাংলাদেশ

| প্রকাশের সময় : ১৭ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৬ এএম

যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বাইগান ভারত সফর শেষে গত বুধবার তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তির ভারত ও বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত গুরুত্ববহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে যে চিন্তিত করে তুলেছে, তা বাইগানের দুই দেশে সফর থেকে বোঝা যায়। যদিও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলে (ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি-আইপিএস) পাশে পাওয়ার জন্য বাইগানের এই সফর। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে বাইগান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সহযোগিতার উদ্যোগ আইপিএসে বাংলাদেশকে দেখতে তারা আগ্রহী। আইপিএসের কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশের অবস্থান। এ কারণেই তিনি বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। তবে এর নেপথ্যে যে উপমহাদেশে চীনের প্রভাব বিস্তার ঠেকানোর কৌশল রয়েছে, তা কূটনীতিবিদরা মনে করছেন। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি অত্যন্ত কূটনৈতিক দক্ষতামূলক বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের নিজের অবস্থানই গুরুত্বপূর্ণ। এ কথাও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দিল্লির চোখে দেখে না। বলা বাহুল্য, কারো সাথে বৈরিতা নয়, সবার সাথে বন্ধুত্ব-কূটনীতির মূলমন্ত্রে থেকে তিনি এ বক্তব্য দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রতিবেশীসহ বিশ্বের সব দেশের সাথেই সমান এবং ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এবং উপমহাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের প্রতি প্রতিবেশীসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর যে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই এবং থাকাও স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সহযোগিতামূলক কর্মকান্ডে সবদেশই বাংলাদেশের কাছে অগ্রগণ্য। নিজের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরইয়ে সই করে। অন্যদিকে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র আইপিএসে যোগ দিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে আলোচনা যাই হোক না কেন, বাইগানের ভারত হয়ে বাংলাদেশ সফর যে প্রধানত উপমহাদেশে চীনের প্রভাব ঠেকানো, তা বিশ্লেকরা ভালভাবেই বুঝতে পারছেন। এর মধ্যে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা এবং কৌশলে বাংলাদেশকে তাদের বলয়ে অন্তর্ভুক্ত করাই আসল লক্ষ্য। করোনাকালে চীন যেভাবে নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তানসহ বাংলাদেশের পাশে সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং করোনা সহায়তা এবং একের পর এক বিনিয়োগে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে, তাতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উদ্বেগ সঞ্চারিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, লাদাখে সীমান্ত নিয়ে চীনের কাছে ভারতের নাকাল হওয়া ও চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মহড়াকে তোয়াক্কা না করা দুই দেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশগুলোর মধ্যকার এসব টানাপড়েনে বাংলাদেশ কখনোই জড়ায়নি। বিতর্কিত কোনো অবস্থানও নেয়নি। বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক স্বার্থে নেপাল, ভুটানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চীনের বাড়িয়ে দেয়া অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে চলেছে। বলা যায়, করোনায় বিধ্বস্ত বিশ্ব অর্থনীতির এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দূরদর্শী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে যেখান থেকে বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যায় সেখান থেকেই তা আদায় করছেন। এক্ষেত্রে চীন, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের সব দেশের সাথেই পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে চলেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ে এবং পাওয়ার ক্ষেত্রে যে দেশে বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে, সে দেশেই সকলের ছুটে যাওয়া স্বাভাবিক। বৃহৎ প্রতিবেশী বা ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যে যদি তাদের আধিপত্য খর্ব হওয়ার শঙ্কা জাগে, তা তাদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কিছু করার নেই। তার নীতি সকলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং কারো সাথে দ্বন্দ্বে না জড়ানো। সাম্প্রতিককালে চীন, নেপাল ও ভুটানের সাথে ভারতের যে টানাপড়েন শুরু হয়, তাতে বাংলাদেশ কোনো ধরনের মন্তব্য করেনি। নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। এ থেকে একটি বিষয় পরিস্কার, বাংলাদেশ কারো নিজস্ব ব্যাপারে জড়াতে চায় না। প্রত্যেকের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতিতে অবিচল।

বাইগানের বাংলাদেশ সফর থেকে যুক্তরাষ্ট্র কি পেল বা পেল না, তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ভারত বা যুক্তরাষ্ট্র কাউকেই যেমন অসন্তুষ্ট করার মতো আচরণ করেনি, তেমনি তাদেরও বলার মতো কিছু নেই। একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি প্রদর্শন করেছে এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কূটনৈতিক দক্ষতা প্রশংসার দাবী রাখে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যে আমাদের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করে সচল করতে সকলেরই পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। বড় দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি তাদের প্রভাব বিস্তারকারী নীতি ও আবদারের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকাই কাম্য। এর ফলে যা হচ্ছে তা হলো, কৌশলগত ভৌগলিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের কাছে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোকে তাদের স্বার্থে আসতে হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের কূটনীতিতে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নীতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং এ থেকে সে উপকৃতও হচ্ছে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন