যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের দিন ঘনিয়ে এসেছে, আর মাত্র সপ্তাহ দুয়েক বাকি। সম্প্রতি জনমত জরিপগুলোয় দেখা যাচ্ছে, ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন অব্যাহত ভাবে বেশ কিছু পয়েন্টের ব্যবধানে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন। শুধু যে জাতীয়ভাবে মার্কিন ভোটাররা কাকে বেশি পছন্দ করছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে সে জরিপেই জো বাইডেন এগিয়ে আছেন তা নয়, যেসব অঙ্গরাজ্যকে বলে ‘সুইং স্টেট’ অর্থাৎ যারা একেক নির্বাচনে একেক প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে বলে দেখা গেছে, সেগুলোতে চালানো জরিপেও দেখা যাচ্ছে জো বাইডেনই এগিয়ে। ডেমোক্র্যাটরা এবার নির্বাচনী প্রচারাভিযানের জন্য যে বিপুল পরিমাণ চাঁদা তুলেছে - তা এক নতুন রেকর্ড। ফলে আর্থিক দিক থেকেও তারা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। এর অর্থ হলো, ভোটের ঠিক আগের সপ্তাহগুলোয় জো বাইডেন তার প্রচারণা ও বার্তা দিয়ে রেডিও-টিভি ছেয়ে ফেলতে পারবেন।
‘ট্রাম্প এবার পুননির্বাচিত হতে পারবেন না’ -এমন অনুমানের পক্ষেই অধিকাংশ নির্বাচনী বিশ্লেষক এখন বাজি ধরছেন। নেট সিলভারের ফাইভথার্টিএইট ডটকম ব্লগ এখন মনে করছে, বাইডেনের জয়ের সম্ভাবনা ৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে ডিসিশন ডেস্ক এইচ কিউ বলছে, এ সম্ভাবনা ৮৩.৫ শতাংশ। তবে ডেমোক্র্যাটরা এরকম অবস্থা আগেও দেখেছে - যারা পরিণতি হয়েছে আশাভঙ্গের বেদনা। চার বছর আগে, নির্বাচনের আগে এমন সময়টায় হিলারি ক্লিনটনেরও জয়ের উচ্চ সম্ভাবনা আছে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপর কী ঘটেছিল তা মনে আছে তাদের। ট্রাম্পের আরেকটি বিজয়ের মধ্যে দিয়ে কি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে পারে? জানুয়ারি মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার শপথ নিচ্ছেন - এ দৃশ্য যদি সত্যি দেখা যায়, তাহলে তার পাঁচটি সম্ভাব্য কারণ এখানে বলা হলো।
১. আরেকটি ‘অক্টোবর বিস্ময়’
চার বছর আগে নির্বাচনের ঠিক ১১ দিন আগে - এফবিআইয়ের পরিচালক জেরেমি কোমি জানিয়েছিলেন, হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় তার ব্যক্তিগত ইমেইল সার্ভার ব্যবহারের ঘটনাটির তদন্ত নতুন করে শুরু করছে তার প্রতিষ্ঠান। এক সপ্তাহ ধরে এ ঘটনা এবং সম্পর্কিত বিষয়গুলো ছিল সংবাদ মাধ্যমে বড় খবর এবং তা ট্রাম্পের প্রচারাভিযানকে দম ফেলার একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল।
এখন ২০২০এর নির্বাচনের আগে বড়জোর দু’সপ্তাহ সময় আছে। যদি এখন সেই রকম রাজনৈতিক ভূমিকম্প ঘটানোর মত কোন কিছু ঘটে যায় - তাহলে সেটাই হয়তো ট্রাম্পকে বিজয় এনে দিতে পারে। এখন পর্যন্ত অবশ্য এ মাসের বড় চমক-লাগানো ঘটনাগুলো ট্রাম্পের বিপক্ষেই গেছে। যেমন: তার কর না দেয়া সংক্রান্ত খবর ফাঁস, এবং দু’নম্বর কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে তার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া।
রক্ষণশীল শিবির অবশ্য অন্য একটি ঘটনাকে প্রচারাভিযানে কাঁপন ধরানোর মতো ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
নিউ ইয়র্ক পোস্ট পত্রিকা একটি রহস্যময় ল্যাপটপ এবং তাতে পাওয়া একটি ইমেইল নিয়ে এক নাটকীয় খবর প্রকাশ করেছে। এতে জো বাইডেনের সাথে তার পুত্র হান্টারের একটি ইউক্রেনিয়ান গ্যাস কোম্পানির লবিইং করার চেষ্টার সংশ্লিষ্টতা আছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এর উৎস প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় এবং সুনির্দিষ্ট কিছুর অভাবের কারণে মনে হয় এটা হয়তো খুব বেশি ভোটারের মত পরিবর্তন করতে পারবে না। ট্রাম্প অবশ্য অঙ্গীকার করেছেন যে, এটা শুরু মাত্র, আরো অনেক কিছু আসছে। যদি তাই হয়, এবং বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময় কোন অন্যায় করার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় - তাহলে তা একটা ভিন্ন এবং বড় ঘটনায় পরিণত হতে পারে।
অথবা এমনও হতে পারে যে, এ প্রচারাভিযানের মধ্যে সবাইকে হতবাক করার মত অকল্পনীয় আরেকটা কিছু খুব শিগগিরই ঘটবে। এটা কী হবে তা যদি আমরা বলতে পারতাম - তাহলে তো কেউ এতে অবাক হবে না।
২. ‘জনমত জরিপ সব ভুল’
মোটামুটি যেদিন থেকে জো বাইডেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছেন - সেদিন থেকেই জাতীয় জনমত জরিপগুলোয় তাকে ট্রাম্পের চাইতে এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে। এমনকি সুইং স্টেটগুলোতে - যেখানে দুই প্রার্থীর মধ্যে সমর্থনের ব্যবধান খুবই সামান্য - সেখানেও জো বাইডেনকে বরাবরই খানিকটা এগিয়ে থাকতে দেখা গেছে। এসব জনমত জরিপে যেটুকু ভুলের সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে ধরে নেয়া হয় - এই ব্যবধানটা তার চেয়েও বেশি।
তবে ২০১৬ সালের নির্বাচনে দেখা গেছে, জাতীয় স্তরের জরিপগুলোয় কে এগিয়ে আছেন তা অপ্রাসঙ্গিক এবং অঙ্গরাজ্য-স্তরের জরিপেগুলোও ভুল হতে পারে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কত লোক আসলে ভোট দিতে যাবেন -এর পূর্বাভাস দেয়া প্রতি নির্বাচনের আগেই জরিপকারীদের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৬’র নির্বাচনে জরিপকারীরা এ ক্ষেত্রে ভুল করেছিল। তারা শ্বেতাঙ্গ এবং কলেজে-পড়েনি এমন ভোটারদের সংখ্যা কম ধরেছিল -যারা বেশি সংখ্যায় ট্রাম্পকে ভোট দেয়।
দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, বাইডেন এখন যে ব্যবধানে এগিয়ে আছেন - তাতে জরিপকারীরা ২০১৬’র মত ভুল করলেও তিনি জিতে যাবেন। তবে জরিপকারী সংস্থাগুলো বলছে, ২০২০ সালের নির্বাচনে তাদের কিছু নতুন বাধা অতিক্রম করতে হচ্ছে। যেমন, বহু আমেরিকানই এই প্রথমবারের মতো ডাকযোগে ভোট দেবার পরিকল্পনা করছে। রিপাবলিকানরা ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছে যে, তারা ডাকযোগে দেয়া ভোটকে জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করবে - কারণ তাদের মতে এখানে ব্যাপক হারে জালিয়াতি হবার সম্ভাবনা আছে, এবং এটা তাদের ঠেকাতে হবে। ডেমোক্র্যাটরা বলছে, এটা আসলে ভোটারদের দমন করার একটা প্রয়াস।
ভোটাররা যদি তাদের ফর্মগুলো ভুলভাবে পূরণ করে অথবা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে, অথবা যদি ডাকযোগে ভোট পাঠানোর ক্ষেত্রে কোন বিঘ্ন বা বিলম্ব হয় - তাহলে এমন পরিস্থিতি হতে পারে যে সঠিকভাবে পূরণ করা ভোটও বাতিল হয়ে যেতে পারে। ভোটকেন্দ্রগুলোর সংখ্যা যদি কম হয়, বা তাতে যদি কর্মকর্তা কম থাকে - তাহলে ৩রা নভেম্বর ভোট দিতে গিয়ে অনেকে অসুবিধায় পড়তে পারেন। এতে হয়তো অনেক আমেরিকান - যাদের জনমত জরিপকারী সংস্থাগুলো সম্ভাব্য ভোটার হিসেবে চিহ্নিত করেছে - তারা হয়তো ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন।
৩. টিভি বিতর্কে যদি ট্রাম্প ভালো করেন
টিভিতে ট্রাম্প ও বাইডেনের প্রথম বিতর্ক নিয়ে হৈচৈ থেমে গেছে, কারণ দু’সপ্তাহ সময় পার হয়ে গেছে। ওই বিতর্কে অবশ্য ট্রাম্পই ছিলেন সবচেয়ে আক্রমণাত্মক। জনমত জরিপগুলোতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ট্রাম্পের সেই আক্রমণাত্মক ভাব, বাইডেনের কথায় বারবার বাধা দেয়া শহরতলীগুলোতে থাকা মহিলাদের ভালো লাগেনি। এ নির্বাচনে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে বাইডেন আক্রমণের মুখেও ছিলেন অবিচল, রিপাবলিকানরা ভোটারদের মনে বাইডেনের বয়স নিয়ে যে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল - সে উদ্বেগ কেটে গেছে।
এখন ট্রাম্পের সামনে প্রথম বিতর্কে তৈরি হওয়া ধারণা পরিবর্তনের শেষ সুযোগ আসছে ২২ অক্টোবর। সেদিন যদি তিনি অপেক্ষাকৃত শান্ত এবং প্রেসিডেন্ট-সুলভ ভাব তুলে ধরতে পারেন এবং বাইডেন যদি কোন নাটকীয় ভুল করে বসেন - তাহলে হয়তো এ প্রতিযোগিতার মোড় ঘুরে ট্রাম্পের পক্ষে চলে যেতে পারে।
৪. সুইং স্টেটগুলোতে বিজয়
যদিও জনমত জরিপগুলোর ফল বাইডেনের পক্ষে যাচ্ছে কিন্তু এমন অনেক অঙ্গরাজ্য আছে যেখানে ট্রাম্পই এগিয়ে আছেন, বা পিছিয়ে আছেন খুব সামান্য ব্যবধানে। এখানে সামান্য এদিক-ওদিক হলেই হয়তো ইলেকটোরাল কলেজের ভোটগুলো ট্রাম্পের পক্ষে চলে আসতে পারে। গত ২০১৬’র নির্বাচনে যেমনটা হয়েছিল, জাতীয়ভাবে জনসাধারণের ভোট ট্রাম্প কম পেয়েছিলেন, কিন্তু ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে ট্রাম্প পান হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে অনেক বেশি। যেসব সুইং স্টেটে ট্রাম্প জিতেছিলেন - যেমন মিশিগান ও উইসকনসিন - সেগুলো এবার তার নাগালের বাইরে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু বাকিগুলোতে যদি ট্রাম্প সামান্য ব্যবধানেও জিতে যান, পেনসিলভানিয়া এবং ফ্লোরিডায় শ্বেতাঙ্গ কলেজে-না-পড়া ভোটারদের আরো বেশি সংখ্যায় ভোট কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারেন - তাহলে তিনি হয়তো ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে জয় নিশ্চিত করে ফেলতে পারেন।
এমন একটা চিত্রও কেউ কেউ তুলে ধরছেন যে, ট্রাম্প এবং বাইডেন উভয়েই যদি ২৬৯টি করে ইলেকটোরাল ভোট পান, তাহলে এই ‘টাই’ অবস্থায় ফল নির্ধারিত হবে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে রাজ্যের প্রতিনিধিদের দ্বারা। সেক্ষেত্রে মনে করা হচ্ছে তাদের বেশির ভাগই ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেবেন।
৫. বাইডেনের কোন ভুল
জো বাইডেন এ পর্যন্ত অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এক প্রচারাভিযান চালিয়েছেন। হয়তো এটা পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছে বা করোনাভাইরাস মহামারি-জনিত বাস্তবতার কারণেই হয়েছে। তবে বাইডেন এমন একজন প্রার্থী - যিনি কখনো কখনো বেফাঁস কথা বলে ফেলতে পারেন বলে মনে করা হয়। তার পরও তিনি এখন পর্যন্ত মোটামুটি সমস্যা এড়িয়ে চলতে পেরেছেন, তার মুখের কথার কারণে কোন সমস্যায় পড়েননি। তবে এখন বাইডেন জোরেশোরে প্রচারভিযানে নেমেছেন। যেহেতু তাকে অনেক বেশি সভাসমাবেশ হচ্ছে - তাই হঠাৎ করে কোন বেফাঁস কথা বলে ফেলার ঝুঁকিও বেড়ে গেছে। জো বাইডেনের নির্বাচনী জোটে বহু ধরনের লোক আছে। এখানে শহরতলীর মধ্যপন্থীরা আছে, ক্ষুব্ধ রিপাবলিকানরা আছে, সংখ্যালঘুরা আছে, আরো আছে শ্রমজীবী ঐতিহ্যগত ডেমোক্র্যাটরা এবং উদারনৈতিকরা। বাইডেন যদি এদের কোন একটি গোষ্ঠীর অসন্তুষ্ট হবার মত কিছু করেন তাহলে তার সমর্থকদের মধ্যে ক্রোধ সৃষ্টি হতে পারে।
এমন সম্ভাবনাও আছে যে প্রচারাভিযান-জনিত ক্লান্তির কারণে জো বাইডেনের যে অনেক বয়স হয়েছে এটা দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে এবং তখন উদ্বেগ দেখা দেবে যে, তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করার উপযুক্ত কিনা। এরকম কিছু হলেই ট্রাম্পের প্রচারণা দল তার সুযোগ নিতে দ্বিধা করবে না। বাইডেনের প্রচারাভিযান দল হয়তো মনে করছে, কোনমতে আর কয়েকটি দিন পার করে দিতে পারলেই হোয়াইট হাউস তাদের কব্জায় এসে যাবে। কিন্তু এখন যদি তারা একটা হোঁচট খায়, তাহলে হয়তো এই রাজনৈতিক দলটি আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বসতে পারে যে, কীভাবে ‘নিশ্চিত জয়ের মুখ থেকে পরাজয় ছিনিয়ে নেয়া যায়’। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন