শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

টেকসই উন্নয়নে দেশীয় সম্পদকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার ক্ষতি সামলাতে কয়েক বছর লেগে যাবে; তাও এখনই শেষ হলে। কিন্তু করোনা এখনই শেষ হচ্ছে না। দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে বিভিন্ন দেশে। ফলে লকডাউন পুনরায় চালু করা হচ্ছে। এরূপ অবস্থা হয়েছে বাংলাদেশেও। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতকালে দেশে করোনার প্রকোপ ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত ২৩ সেপ্টেম্বর বলেছেন, ‘দেশে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী করোনার ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ দেশের মানুষ করোনার ভয়াবহতাকে তেমন আমলে নেয়নি। তাই স্বাস্থ্যবিধি পালন করেনি বেশিরভাগ মানুষ। ভবিষ্যতেও তাই হবে, যদি বাধ্য করা না হয়। অপরদিকে, দেশে করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থা বৈশ্বিকভাবে নিম্ন। ওয়ার্ল্ডোমিটারের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত তথ্য মতে, ‘করোনা আক্রান্তে শীর্ষ ৩৫টি দেশের মধ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সর্বনিম্ন নমুনা পরীক্ষা হয়েছে বাংলাদেশে। এক লাখের ওপর রোগী শনাক্ত হয়েছে এমন দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন নমুনা পরীক্ষায় মিশরের পরই অবস্থান বাংলাদেশের। আর রোগী শনাক্তে শীর্ষ ১০০টি দেশের মধ্যে নমুনা পরীক্ষায় ৮৭টি দেশের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে রোগী শনাক্তে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম।’ করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি। উপরন্তু করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থা যেটুকু ছিল, তারও অনেক হ্রাস করা হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। করোনার এন্টিবডি ও এন্টিজেন পরীক্ষার কিট আবিষ্কার করেছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তার তরফে এটা দেশে ব্যবহার করার জন্য বহু চেষ্টা করা হয়েছে তবে সরকারি অনুমোদন পাওয়া যায়নি। সরকার এটা আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। আমদানিকৃত এ পণ্যের মান ও মূল্য নিয়ে নতুন কেলেঙ্কারি ঘটতে পারে বলে আশংকা রয়েছে। দ্বিতীয়ত দেশীয় পণ্যকে ব্যবহারের অনুমোদন না দিয়ে একই পণ্য আমদানির অনুমোদন দেওয়ায় দেশীয় উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহ হতে পারে। গণস্বাস্থ্যের এন্টিবডি ও এন্টিজেন কিটের আবিষ্কারক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ড. বিজন কুমার শীল ওয়ার্ক পারমিট না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে চলে গেছেন সিঙ্গাপুরে। অথচ এ দেশে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই অবৈধভাবে লাখ লাখ বিদেশি কাজ করছে বিভিন্ন খাতে। অথচ এ দেশেরই সন্তান ও বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী দেশে কাজ করার অনুমতি পাননি! এভাবে বহু প্রখ্যাত ব্যক্তি দেশে মূল্যায়িত না হওয়ায় অন্য দেশে চলে গেছেন এবং সেখানে বিশেষ অবদান রাখছেন। দেশে যদি তারা মূল্যায়িত না হন এবং দেশ ছেড়ে চলে যান, তাহলে দেশের উন্নতি হবে কীভাবে? সেকেলে শিক্ষানির্ভর ও অদক্ষ-দুর্নীতিপরায়ণ আমলা এবং বাটপার দলদাসদের দিয়ে? মোটেও না। দেশের কাক্সিক্ষত উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তা যেমন প্রয়োজন, তেমনি তাদের সঠিকভাবে কাজে লাগানো দরকার।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ‘করোনায় বাংলাদেশে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন শহরাঞ্চলের ৬৬% ও গ্রামাঞ্চলের ৪১% কর্মী।’ এ ক্ষতি আরও বাড়বে। এ জন্য কেউ দায়ী নয়। প্রাকৃতিক নিয়মেই এটা হয়েছে। তাই করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক মহামন্দা মোকাবেলা করেই চলতে হবে এবং যথাশিগগির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বাঁচার ও উন্নতির কৌশল নির্ণয় করতে হবে। আর তা হওয়া প্রয়োজন দেশীয় সম্পদ ভিত্তিক। নতুবা বিদেশনির্ভর হলে গার্মেন্ট, প্রবাসী আয় ও পিঁয়াজের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। দেশীয় সম্পদ ভিত্তিক উন্নতির প্রথম খাত হচ্ছে কৃষি। দ্বিতীয় খাত হচ্ছে জলাধার ও সমুদ্র। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ। কৃষির উন্নতিও হয়েছে ব্যাপক। গত ৩০ জুন এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘বর্তমানে বিশ্বে কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান- চালে চতুর্থ, স্বাদু পানির মাছে তৃতীয়, সবজিতে তৃতীয়, মোট ইলিশে ৮৬%, ছাগলে চতুর্থ, আলুতে অষ্টম, ফলে দশম, কাঁঠালে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম ও পেঁপেতে ১৪তম।’ অবশ্য গত ৭ আগস্ট এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে প্রায় ৬৪.৩৪ লাখ টন চাল ও গম আমদানি হয়েছে। যার সিংহভাগই ছিল গম।’ বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট মতে, ‘বাংলাদেশের খাদ্যপণ্য আমদানিতে বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়।’ এছাড়াও বিপুল অংকের খাদ্যদ্রব্য দেশে চোরাচালান হয়ে আসে। অবশ্য, কিছু কৃষি পণ্য রফতানিও হয়। গম, ভোজ্য তেল, চিনি ও মসল্লা জাতীয় পণ্যের চাহিদার বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। অন্যদিকে, ব্যাপক সংখ্যক মানুষ পুষ্টিহীনতার শিকার হয়েছে। তাই সঠিকভাবে খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা, উৎপাদন ও পুষ্টিগুণ নির্ণয় করে পরিকল্পিতভাবে উৎপাদনের দিক গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে খাদ্য পণ্যেরঘাটতি ও পুষ্টিহীনতা দূর হবে। কৃষিপণ্যকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য মূল্য হ্রাস ও মানোন্নয়ন করতে হবে। সে জন্য কৃষিকে শতভাগ যান্ত্রিকরণ, লেটেস্ট প্রযুক্তি ও হাইব্রিড ব্যবহার, কৃষি উপকরণসমূহ ও ঋণপ্রাপ্তি সহজীকরণ, সংরক্ষণাগার, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সুষ্ঠ বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া, ফসলের বহুমুখীকরণ ও কৃষি জমিকে রক্ষা করা দরকার। সর্বোপরি কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা কৃষক ফসল ফলাবে না। উপরন্তু খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারিভাবে কমপক্ষে ৫০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য মজুদ রাখার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। অর্গানিক ফুডের চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশ-বিদেশে। তাই এই বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি পরপর কয়েকবারের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শাক-সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই মূল্য অত্যাধিক। আমন ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক হবে কি-না সন্দেহ আছে। বিষয়টি মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে যাচাই করে সম্ভাব্য ঘাটতি চাল এখনই আমদানি করে মজুদ করা দরকার। নতুবা চরম খাদ্য সংকট সৃষ্টি হতে পারে। আসন্ন শীতকালীন ফসল ও ইরি-বোরো ধান উৎপাদনের দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পাট ও চামড়া পণ্যের চাহিদা বাড়ছে বিশ্বব্যাপীই। তাই এই দু’টি পণ্যের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা আবশ্যক। রাজশাহী অঞ্চলে পরীক্ষামূলক পাম চাষে ব্যাপক সাফল্য এসেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ। সংস্থাটির এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু পাম গাছের জন্য খুবই উপযোগী। সঠিকভাবে পামের চাষাবাদ, উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে দেশে ভোজ্য তেলের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব। তাই দ্রুত সারা দেশে পাম চাষ ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।

দেশীয় সম্পদভিত্তিক উন্নতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে নদী, পুকুর ইত্যাদি ও সমুদ্র। দেশটি নদীমাতৃক। কিন্তু দেশে মোট নদীর সংখ্যা কত তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন: ১৩শ’,১১শ’, ৭শ’, ৪০৫ ইত্যাদি। অন্যদিকে, বিআইডব্লিউটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০ সালে এ দেশে নদীর মোট দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার। এখন মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটারে নৌযান চলাচল করতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে এটি আরও কমে হয়ে যায় ৪,৩৪৭ কিলোমিটার।’ উপরন্তু বর্তমানে যেটুকু নদী আছে, তারও বেশিরভাগের নাব্য থাকে না অধিকাংশ সময়। ফলে নৌযান চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে। দেশের নদীর এ করুণ পরিণতি হয়েছে ভারতের পানি আগ্রাসন ও সংস্কার না করার কারণে! তাই নদীগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভালভাবে ড্রেজিং করা দরকার। পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘দেশের ৬৪ জেলায় ৪৩২টি খাল খননের কার্যক্রম চলছে। এটা শেষ হলেই সারা দেশে ৫শ’ নদী খননের কাজ শুরু হবে।’ এর আগে গত ২০ জুলাই নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘ড্রেজিংয়ে স্বচ্ছতা আনতে ড্রেজিং কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য রিয়েল টাইম ড্রেজ মনিটরিং সিস্টেম চালু করা হবে। আগামী এক মাসের মধ্যে এ সিস্টেমটি পুরোদমে চালু হবে। এর ফলে ড্রেজিংয়ের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে পানির নিচে কী করা হচ্ছে, কতটুকু ড্রেজিং হচ্ছে সে বিষয়গুলোর স্বচ্ছতা প্রকাশ পাবে। ঘণ্টা, দিন, প্রশস্ততা, গভীরতা ও অ্যালাইনমেন্ট অনুযায়ী ড্রেজিং হচ্ছে কিনা তা সহজে জানা যাবে। ফলে ড্রেজারের বিলিং সিস্টেম আরও সহজ হবে।’ মন্ত্রীদের এসব বক্তব্য উৎসাহজনক। তাই এসব কর্ম নির্দিষ্ট সময়ে ও ভালভাবে সম্পন্ন হওয়া দরকার। আদালত কর্তৃক নদীকে জীবন্ত সত্তা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৪ সালে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’ গঠন করা হয়েছে। কমিশন প্রায় ৫০ হাজার নদী দখলদারের তালিকা প্রকাশ করেছে। সে তালিকা অনুযায়ী, ২৫% দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকীগুলো প্রভাবশালী হওয়ায় উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না বলে খবরে প্রকাশ। নদী খেকোরা রাষ্ট্রীয় শক্তির চেয়ে বেশি বলদর্পী নয়। তাই অবিলম্বে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে সব নদীকে দখলমুক্ত করা এবং পুনঃদখল যেন না হয় সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া, সব নদীকে দূষণমুক্ত করা দরকার। পলিথিন, প্লাস্টিক পয়ঃনিষ্কাসন ও শিল্পবর্জ্যে নদীর পানি চরম দূষিত হয়ে ব্যবহারের অনোপযোগী হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি সিএনএন’র খবরে প্রকাশ, ‘বাংলাদেশসহ এশিয়ার নদ-নদীগুলোর পানি ক্রমাগত বর্ণ হারাচ্ছে। এর ফলে সার্কভুক্ত দেশগুলোসহ এশিয়ার অনেক দেশ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।’ তাই নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করা জরুরি। বালু উত্তোলনের কারণে নদীর ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাই এই অপকর্মও বন্ধ করা দরকার। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার জন্য ভারতের সাথে অবিলম্বে চুক্তি করা আবশ্যক। ফারাক্কা চুক্তিকে রিভিউ করে গ্যারান্টি ক্লজ সংযুক্ত করা দরকার। চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ না থাকায় এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে, এ বছরের মধ্যে যদি ভারত গ্যারান্টি ক্লজসহ তিস্তা নদীর ন্যায্য পানি বণ্টন চুক্তি না করে, তাহলে আগামী জানুয়ারিতেই চীনের ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ প্রস্তাব অনুমোদন এবং তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি। এর বিকল্প নেই। কারণ, ভারতের আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা করে বসে থাকলে দেশের ভয়াবহ ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। উল্লেখ্য যে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বর্ধিত করে বাংলাদেশে তিস্তার পুরনো মূল অববাহিকায় অবস্থিত আত্রাই, করতোয়া এবং পুনর্ভবা নদীকে এর আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি। সংস্থাটি বলেছে, এটা করা হলে প্রকল্পের ব্যাপ্তি চার হাজার বর্গকিলোমিটারের জায়গায় হবে ২৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। সংস্থাটির এ দাবি যুক্তিযুক্ত। কারণ, এ অঞ্চল হচ্ছে দেশের শস্যভান্ডার। তাই উক্ত সংস্থার দাবির ব্যাপারে ভেবে দেখা দরকার। প্রতি বছর নদী ভাঙ্গনে দেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাই নদী ভাঙ্গন রোধ কল্পে টেকসই ব্যবস্থা করা আবশ্যক। দেশে লাখ লাখ পুকুর, দীঘি, খাল, বিল, হাওর ও জলাশয় আছে, যার অধিকাংশ মজে গেছে। এসবও ভালভাবে সংস্কার করা জরুরি।

দেশের সমুদ্রসীমা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য হচ্ছে: বঙ্গোপসাগরে বর্তমানে নিজস্ব সমুদ্র অঞ্চল হচ্ছে, ১ লাখ ১৮ হাজার ১১৩ বর্গকিলোমিটার। আর ভূ-ভাগের আয়তন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ বর্তমানে দেশের সমুদ্র জলসীমার পরিমাণ স্থলের ৮১%। উপক‚লীয় সমুদ্ররেখা ৭০০ কিলোমিটার। দেশের জলসীমার অভ্যন্তরে রয়েছে প্রায় ৪০টি ছোট দ্বীপ, যাতে মানুষের কোন বসবাস নেই। গত ১৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গোপসাগরের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ববিষয়ক এক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। তাতে মূল প্রবন্ধে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘বঙ্গোপসাগর বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর। এই অঞ্চলে সভ্যতা, পরিবেশগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে এর তাৎপর্য রয়েছে। বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগর অঞ্চলের একটি প্রধান অংশ। পাশাপাশি এটি ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগকারী হওয়ার কারণে আঞ্চলিক ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এ অঞ্চলটি মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, ভুটান ও নেপালজুড়ে রয়েছে। ২.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্মিলিত জিডিপিসহ গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৩.৪%-৭.৫%। বঙ্গোপসাগর বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তি, ব্যবসা ও করপোরেট স্বার্থের শ্বাসপ্রশ্বাস। তাই বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানটি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ বাংলাদেশ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ইউরেনিয়াম, প্লাটিনাম, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, সিসা, জিঙ্ক ও সালফাইড, সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ও মহামূল্যবান ধাতু রয়েছে,’ যা ‘কালো সোনা’ বলে খ্যাত। সেভ আওয়ার সি’র মতে, ‘বঙ্গোপসাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি আছে। এ ছাড়াও সমুদ্রসীমায় নানা ধরনের প্রবাল, গুল্মজাতীয় প্রাণী, তিন প্রজাতির লবস্টার, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক পাওয়া যায়। উপক‚লীয় অঞ্চলের ৫ লাখ জেলের জীবিকার উৎস সমুদ্র।’ এছাড়া, দেশের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯০% হয় সমুদ্রপথে, যার পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো। গত ২০ সেপ্টেম্বর এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও সমুদ্র সম্পদ আহরণে পিছিয়ে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারত, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা তাদের সমুদ্রসম্পদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে যুক্ত করছে। বাংলাদেশ এখনও পরিকল্পনার মধ্যেই আটকে আছে। সমুদ্রসীমার জলরাশির তলদেশে কী বিশাল সম্পদ লুকিয়ে আছে, তা এখনও পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারেনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর মিয়ানমার তার গ্যাস ব্লকগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে। ‘থালিন-এক’ নামক ব্লকে প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে ও গ্যাস উত্তোলন শুরু করেছে। ভারত বঙ্গোপসাগরে তার অংশের কৃষ্ণা-গোদাভারী বেসিন এলাকায় প্রায় ৫০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদের আশা করছে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘২৫টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্লু-ইকোনমি সেল গঠন করা হয়েছে।’ মৎস্যমন্ত্রী বলেন, ‘পর্যাপ্ত জাহাজ ও উন্নত প্রযুক্তির অভাবে সমুদ্রসীমার ৬শ’ কিলোমিটারের মধ্যে মাছ ধরা হয় মাত্র ৬০ কিলোমিটারে। দেশের সমুদ্রসীমায় আশি লাখ টন মাছের মজুত থাকে। কিন্তু দেশের জেলেরা ধরে মাত্র সাত লাখ টন মাছ। সমুদ্রে মাছ আহরণ বাড়াতে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প একনেকে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে ২০২২ সালের মধ্যে টেকসই উপক‚লীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ- শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে মৎস্য অধিদপ্তর। আটটি দেশ মিলে বে অব বেঙ্গল প্রকল্প করেছে, তার সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে। তবে সবকিছুই এখনো পরিকল্পনার মধ্যেই আটকে আছে।’ ব্লু ইকোনমি সেলের উপদেষ্টা খুরশিদ আলম বলেন, ‘সমুদ্র অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট ও মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছে। সমঝোতা চুক্তি করার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। আগ্রহ প্রকাশ করছে জাপান। দেশের ব্লু ইকোনমি খাতে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা করতে আগ্রহী ফ্রান্সের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিএলএস। শিগগিরই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে ব্লু ওশান ইকোনমি।’ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে পারলে বছরে দুই লাখ কোটি ডলার আয় করতে পারবে বাংলাদেশ।’

সমুদ্রসীমার তেল, গ্যাসসহ খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, উত্তোলন ও সরবরাহ ইত্যাদি খুবই ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এজন্য ব্যাপক দক্ষ জনবলের প্রয়োজন। মাছ ধরতে এসব লাগে না। শুধুমাত্র গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার মতো বড় ও প্রযুক্তি সম্বলিত প্রয়োজনীয় বড় ট্রলার, পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেলে ও নিরাপত্তা দরকার। এসব হলেই বছরে অন্তত ৫০-৬০ লাখ মেট্রিক টন মাছ ধরা সম্ভব। কিন্তু তা হচ্ছে না কেন? দ্বিতীয়ত এত সহজ সরল কাজটা না পারলে বিদেশি দক্ষ কোম্পানিগুলোকে ৫০:৫০ শেয়ারের প্রস্তাব দিলেই তো অনেক কোম্পানি পাওয়া যায়। তারা মাছ ধরে অর্ধেক দিলেও আমাদের বিশাল পাওনা হয়ে যায়। নাকি এই অতি সহজ কাজটি করতেও সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আমলাদের ব্যয়বহুল বিদেশে প্রশিক্ষণ ইত্যাদি করতে কয়েক বছর লেগে যাবে? যেটাই হোক, খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। বিশ্বজুড়ে ব্যাপক চাহিদাপূর্ণ মাছ হচ্ছে টুনা মাছ। কথিত আছে, জাপানে একটি টুনা মাছের মূল্য দিয়ে একটি টয়োটা কার পাওয়া যায়। সেই টুনা মাছ ব্যাপক রয়েছে আমাদের সমুদ্রসীমায়। সমুদ্র সম্পদ ভিত্তিক প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক তৈরি করতে হবে। কারণ, এ ধরনের দক্ষ লোক তেমন নেই দেশে। এছাড়া, সাগরের দ্বীপগুলোতে এবং উপকূলে সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা দরকার। সাগরে ভাসমান পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র করা যেতে পারে। এটা রাশিয়া ও চীনে আছে। সর্বোপরি সাগরের পানি থেকে বিপুল হাইড্রোজেন উৎপাদন করে যানবাহনে ব্যবহার করা সম্ভব। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ফরাসি লাইফ উদ্যোক্তা কোম্পানি ঘোষণা করেছে, ‘পশ্চিম ফ্রান্সে নান্ত শহরের অদূরে অবস্থিত পরিকল্পিত উপকূলীয় স্থানে বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে সামুদ্রিক পানি থেকে হাইড্রোজেন উৎপাদন করা হবে। আগামী মে মাসে এর কার্যক্রম শুরু হবে এবং এ থেকে কোন কার্বন নিঃসরণ হবে না। দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদিত এক টন হাইড্রোজেন ঐ এলাকার হাইড্রোজেন চালিত বাসসমূহে সরবরাহ করা হবে।’ বিশ্বের প্রথম হাইড্রোজেন চালিত উড়োজাহাজ নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে এয়ারবাস। গত ২১ সেপ্টেম্বর সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে হাইড্রোজেনচালিত উড়োজাহাজ নির্মাণের প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ সবুজ হাইড্রোজেনচালিত ইঞ্জিন তৈরিতে শতকোটি ইউরো বিনিয়োগ করছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে যানবাহন চালিত হবে হাইড্রোজেন দিয়ে। যা’হোক, দেশের সমগ্র উপকূলে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে ব্যাপক আয় হবে। এই অবস্থায় সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য বিদেশি সহায়তার প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে খুব দ্রুত সাড়া দেওয়া আবশ্যক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন